পাতা:প্রবাসী (ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/১৪৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

১ম সংখ্য ] আমাদের কথা, ১১৯, আমার শ্বশুর ও রবি, দুইজনে মিলিয়া বিদ্যারত্ব মহাশয়কে বন্দোবস্ত করিয়া দিয়াছিলেন, এক বৎসর তিনি প্রত্যহ আমাকে ওই সকল ধৰ্ম্মপুস্তক পড়াইয়া শুনাইয়াছিলেন। বলুর মৃত্যুর পর পনের-ষোল বছর আমার স্বামী উন্মাদ অবস্থাতেই বাচিয়া ছিলেন, মাঝে মাঝে বলুকে খোজ করিতেন। আমি সেই সময় হইতে গেরুয়া কাপড় পরিতে আরম্ভ করি, হাতে দুগাছি শাখা রাখিয়াছিলাম। আমার এই গেরুয়া বসনের জন্য তিনি প্রায় জিজ্ঞাসা করিতেন যে কেন আমি এইরূপ বেশ পরিবর্তন করিয়াছি। আমি তাহাকে বলিতাম যে আমার পিতা পরিতেন তাই আমিও পরিতেছি, তাহার নিকট এই দুঃখের সংবাদটা নিজ মুখে দিতে পারি নাই। সংসারের কৰ্ম্মের ভিতর, আমি আমার মনকে আরও দৃঢ়ভাবে নিয়োগ করিতে লাগিলাম। মানুষের দুঃখের লাঘব, একমাত্র কৰ্ম্মবন্ধু । কৰ্ম্মের ভিতর মানুষ নিজের অতি প্রচণ্ড দুঃখকেও ভুলিয়া থাকিবার স্থযোগ খুজিয়া পায়। আমার এত বৃদ্ধ বয়সেও সেই কৰ্ম্মকে পরিত্যাগ করিতে পারিলাম না। স্বামী যতদিন বাচিয়াছিলেন র্তাহার সেবাশুশ্ৰুষা করা, পুত্রবধূকে দেখা, এই সকল ভার আমার উপরে পড়িল । তাহা ছাড়া আমার ভাই, ভাইপোরা, প্রায়ই আমার কাছে আসিয়া থাকিতেন, তাহদের তত্ত্বাবধান করা–এই সব কাজে নিজেকে ব্যাপৃত রাখিতে লাগিলাম। শিবপ্রসন্নকে ছোট হইতেই প্রতিপালন করিয়াছিলাম, সেও আমাকে খুব ভালবাসিত, তাহার বিবাহের কয়েক বছর পরেই সেও আমাকে ফাকি দিয়া চলিয়া গেল। . আমার পুত্রবধূ সাহানাকে ইংরাজী স্কুলে ভত্তি করিয়া দিলাম, ভাবিলাম লেখাপড়ার ভিতর নিজের মনকে নিয়োগ করিতে পারিলে মনে অনেকটা শাস্তি পাইবে, শিক্ষার স্বারা মনের উন্নতি লাভ হওয়া সম্ভবপর—অবশ্য যদি প্রকৃত শিক্ষা পায়। কিছুদিন পরে সে বিলাতে ট্রেনিং পড়িবার জন্য গিয়াছিল, কিন্তু কিছুদিন থাকিবার পর শরীর অমুস্থ হওয়ায় ফিরিয়া আসিতে বাধ্য হইল । সে যাহা করিতে চাহিত আমি কখনই তাহাতে বাধা দিই নাই, তাহার শরীর মন যাহাতে । প্রফুল্প থাকে তাহারই চেষ্টা করিতাম। বিলাত হইতে ফিরিয়া আসিবার পর তাহার শরীর সুস্থ হইলে সেলাই পড়াশুনার মধ্যে সে তাহার দিনগুলি কাটাইতে লাগিল, সংসারের কাজকৰ্ম্ম দেখাশুনা সে তেমনভাবে করিতে পারিত না, আমিও তাঁহাকে কখনও করিতে দিই নাই। বলুর স্ত্রী বলিয়া, পাছে তাহার কোনও বিষয়ে কষ্ট হয় সেইজন্য সৰ্ব্বদা তাহাতে আমার মন পড়িয়া থাকিত। বলু মারা যাওয়াতে এবং স্বামী উন্মাদ হওয়ার জন্য আমরা আমাদের বিষয় হইতে বঞ্চিত হইলাম। যতদিন আমরা বাচিয়া থাকিব ততদিন পর্য্যন্ত এই বাড়ীর একটা অংশ ভোগ করিবার অধিকার এবং মাসাহারা পাইবার ব্যবস্থা হইল। এই বন্দোবস্তের ভিতরেই আমরা জীবনযাত্রা নির্বাহ করিতে লাগিলাম, কিন্তু দিন দিন সকল জিনিষই অত্যন্ত দুৰ্ম্ম ল্য হওয়ার দরুণ সেই সামান্য অর্থে সংসার নির্বাহ হওয়া কঠিন হইলে আমাদের বাড়ীর অংশ ত্যাগ করিয়া অন্যত্র বাড়ী ভাড়া করিয়া থাকিতে বাধ্য হইলাম। প্রথম শিবপুরে বাড়ীভাড়া করিয়া আমার বোঝি স্বৰ্ষমার সঙ্গে কিছুকাল বাস করি, সেখানে বাড়ীটিতে নানা অসুবিধার জন্য পুনরায় ব্যাটারিতলায় বাড়ীভাড়া করিয়াছিলাম। বাড়ীটি বেশ বড় ছিল কিন্তু অনেক দিন পর্য্যস্ত মেরামত না হওয়ায় অতিশয় জীর্ণ অবস্থায় পড়িয়া ছিল । বাড়ীটি লইয়া বেশ কিছু অর্থব্যয় করিয়া উহার জীর্ণতার আবরণ আমাদের ঘুচাইতে হইয়াছিল। সেই বাড়ীতে কিছুদিন থাকার পর সাহানার শরীর হঠাৎ বড়ই অসুস্থ হয় এবং সেইজন্য মাথার নানারকম পীড়া হইতে আরম্ভ হইলে সে আবার জোড়াসাকো বাড়ীতে চলিয়া আসে। আমি তখন সেখানে একলা, কেবলমাত্র একটি ঝি সহায় । আমার আর এক ভাইপো, হরিপ্রসন্ন আমার কাছে থাকিত, সারাদিন তাকে তাহার কাৰ্য্যের জন্য বাহিরে থাকিতে হইত। রাত্রি যখন দশটা, সাড়ে দশটা তখন সে বাড়ী ফিরিত। বাড়ীটি • মুসলমানপাড়ার ভিতরে ছিল, নানা রকম বিপদের ভিতর বাস করা সত্বেও এই নির্জন পুরী আমার মনে কেমন একটা শাস্তি আনিয়া দিল, নিজের জীবনের প্রত্যেক মুহূৰ্ত্তও অবস্থাগুলিকে তখন মিলাইয়া দেখিবার