পাতা:প্রবাসী (ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/২৬৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

২৩e গিইচি—আপনি এক ভলুম গিবন দেবেন কিন্তু আজি-ক গিবন উৎসাহে পড়িয়া বাড়ী লইয়া যায় বটে কিন্তু ভাল লাগে না। এত খুটিনাটি বিরক্তিকর মনে হয়। পরদিন সেখান ফেরৎ দিয়া অন্য ইতিহাস লইয়া গেল । পূজার কিছু পূৰ্ব্বে অপুদের বাস উঠিয় গেল। খরচে আয়ে অনেকদিন হইতেই কুলাইতেছিল না, সুরেশ্বরের ভাল টুইশনিটি হঠাৎ হাতছাড়া হইল—কে বাড়তি খরচ চালায় ? নিৰ্ম্মল ও জানকী অন্য কোথায় চলিয়া গেল, স্বরেশ্বর গিয়া মেসে উঠিল। অপুর যে মাসিক আয়, কলেজের মাহিনা দিয়া তাহা হইতে মোট বারো টাকা বঁাচে-কলিকাতা সহরে বারো টাকায় যে কিছুতেই চলিতে পারে না, অপুর সে জ্ঞান এতদিনেও হয় নাই । স্বতরাং সে ভাবিল বারো টাকাতেই চলিবে, খুব চলিবে। বারে টাকা কি কম টাকা ! কিন্তু বারো টাকা আয় বেশী দিন রহিল না, একদিন পড়াইতে গিয়া শুনিল ছেলের শরীর খারাপ বলিয়৷ ডাক্তারে হাওয়া বদলাইতে বলিয়াছে, পড়াশুনা এখন বন্ধ থাকিবে । এক মাসের মাহিনী তাহার বাড়তি দিয়া জবাব দিল । টাকা কয়টি পকেটে করিয়া সেখান হইতে বাহির হইয়া অপু আকাশ পাতাল ভাবিতে ভাবিতে ফুটপাথ বহিয়া চলিল । সুরেশ্বরের মেসে সে জিনিষপত্র রাখিয়া দিয়াছে, সেখানেই গেষ্ট-চার্জ দিয়া থায়, রাত্রে মেসের বারীন্দীতে শুইয়া থাকে । টাকা যাহা আছে, মেসের দেন মিটাতেই যাইবে । সামান্য কিছু হাতে থাকিতে পারে বটে কিন্তু তাহার পর ?-- স্বরেশ্বরের মেসে আসিয়া একখানি নিজের নামের পত্র ডাকবাক্সে দেখিল । হাতের লেখাটা সে চেনে না— খুলিয়া দেখিল চিঠিখানা মায়ের কিন্তু অপরের হাতের লেখা । হাতে ব্যথা হইয়া মা বড় কষ্ট পাইতেছে, অপু কি তিনটি টাকা পাঠাইয়া দিতে পারে ? ম৷ কখনো কিছু চায় না, মুখ বুজিয়া সকল দুঃখ সহ করে, সে-ই বরং দেওয়ানপুরে থাকিতে নানা ছল-চুতীয় মাঝে মাঝে কতটাক মায়ের কাছ হইতে লইয়াছে। প্রবাসী—জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩৭ হাতে না থাকিলেও তেলিবাড়ী হইতে চাহিয়া চিস্তিয়া মা যোগাড় করিয়া দিত। খুব কষ্ট না হইলে কখনো মা তাহাকে টাকার জন্য লেখে নাই । পকেট হইতে টাকা বাহির করিয়া গুণিয়া দেখিল সাতাশটি টাকা আছে । মেসের দেন সাড়ে পনেরো টাকা বাদে সাড়ে এগারে টাকা থাকে মাকে কত টাকা পাঠানো যায় ? মনে মনে ভাবিল—তিনটে টাকা তো চেয়েচে, আমি দশটাকা পাঠিয়ে দিই, মনিঅৰ্ডার পিওন যখন টাকা নিয়ে যাবে, মা ভাববে বুঝি তিন টাকা কিংবা হয়তে দু’ টাকার মনিঅৰ্ডার—জিগ্যেস করবে, কত টাকা ? পিওন যেই বলবে দশ টাকা, মা অবাক হয়ে যাবে। মাকে তাক লাগিয়ে দেবো—ভারী মঞ্জ হবে, বাড়ীতে গেলে মা শুধু সেই গল্পই করবে দিন রাত – অপ্রত্যাশিত টাকা প্রাপ্তিতে মায়ের আনন্দোজ্জল মুখ খান কল্পনা করিয়া অপু ভারী খুসি হইল। বৌবাজার পোষ্টাপিস হইতে টাকাটা পাঠাইয়া দিয়া সে ভাবিল— বেশ হোল ! আহা, মাকে কেউ কখনো দশ টাকার মণিঅর্ডার এক সঙ্গে পাঠায় নি—টাকা পেয়ে খুসি হবে । আমার তো এখন রৈল দেড় টাকা, তারপর একটা কিছু ঠিক হয়েই যাবে। কলেজে একটি ছেলের সঙ্গে তাহার খুব বন্ধুত্ব হইয়াছে। সেও গরীব ছাত্র, ঢাকা জেলায় বাড়ী, নাম প্রণব মুখার্জি। খুব লম্বা, গৌরবর্ণ, দোহার চেহারা, বুদ্ধিপ্রোজ্জল দৃষ্টি। কলেজ-লাইব্রেরীতে এক সঙ্গে বসিয়া বই পড়িতে পড়িতে দুজনে আলাপ । এমন সব বই দুজনে লইয়া যায়, যাহা সাধারণ ছাত্রেরা পড়ে না, নামও জানে না। ফাষ্ট-ইয়ারের ছেলেকে মম্‌সেন লইতে দেখিয়া প্রণব তাহার দিকে প্রথম আকৃষ্ট হয়। আলাপ ক্রমে বন্ধুত্বে পরিণত হইয়াছে। অপু শীঘ্রই বুঝিতে পারিল প্ৰণবের পড়াশুনা তাহার অপেক্ষা অনেক বেশী । অনেক গ্রন্থকারের নামও সে কখনও শোনে নাই—নীটশে, এমাসন, টুর্গেনিভ, ত্ৰেষ্টেড প্রণবের কথায় সে ইহাদের বই পড়িতে আরম্ভ করিল। তাহারই উৎসাহে সে পুনরায় ধৈৰ্য্য ও অধ্যবসায়ের সহিত গিবন সুরু করিল, ইলিয়াডের অনুবাদ পড়িল ।