পাতা:প্রবাসী (ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৩১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

సిపి প্রবাসী—বৈশাখ, ১৩৩৭ [ ৩০শ ভাগ, ১ম খণ্ড শহরে—কৰ্ম্মস্থলে। মা ও অন্ত ভাইবোনের কলকাতাতেই রয়ে গেলেন। ঠিক হ’ল যে, এবার থেকে র্তার কলকাতাতেই থাকবেন। স্কুলের গ্রীষ্মের ছুটির সময় মতিলালরা যাবে বাবার কাছে, আর পূজো ও বড়দিনের ছুটির সময় বাবা আসবেন তাদের কাছে। মতিলাল সেরে উঠে আবার স্কুলে যেতে আরম্ভ করলে। কিছুদিনের মধ্যেই আড্ডায় নিয়মিত হাজিরাও পড়তে লাগল। কিন্তু ছাতের কোণে সেই চাদমুখের উদয় হ’লেই সে আর বস্ত না, কোনো রকম ছুতে ক’রে পালিয়ে যেত। চাদমুখ দেখে সরে পড়বার কারণটা আমাদের কাছে যতই সে ঘুরিয়ে বলুক না কেন, আমরা ঠিক বুঝতে পারতুম, চন্দ্ৰবদনের প্রতি তার আকস্মিক এই যে বিতৃষ্ণ এর মূলে আছে দোতালার ছাতের সেই প্রেমকাহিনী । আমরা সভায় নিজেদের যে প্রেমকাহিনীর বর্ণনা করেছিলুম তার মধ্যে অন্ততঃ বাড়ীঘরগুলো ছিল সত্যি, কিন্তু মতিলাল আতখানি গৌরচন্দ্রিকার পর এমন একটি গল্প ছাড়লে যে তার মধ্যে সত্যের রেশটুকু পর্য্যন্ত নেই । খোলার বাড়ীর দোতালার ছাতের কথা নিয়ে তার অসাক্ষাতে আমাদের মধ্যে মাঝে-মাঝে খুব হাসির ধূম পড়ে যেত। হয়ত মতিলালের কানে কোনো স্বত্রে কিছু পোঁচেছিল। তাই সে ইদানীং চাদের সঙ্গে চাদমুখের উদয় দেখলেই পালিয়ে যেত। কিন্তু একদিন সত্যই বাঘ এল । মতিলালের বাবা বিহারের যে শহরে তখন হাকিমী করছিলেন সেই শহরের একজন উকীল ছিলেন তার বিশেষ বন্ধু | উকীল বন্ধটির দু-তিন পুরুষ ধরে এখানে বাস। তার বাবা ও ঠাকুরদাদা সে অঞ্চলে বেশ বিষয়-আশয়ও ক’রে গিয়েছেন । র্তাদেরই একখানা বাড়ী ভাড়া নিয়ে মতিলালেরা সেখানে থাকৃত। বাড়ীর পাশে বাড়ী হওয়ায় দুই পরিবারের মধ্যে সম্ভাবও ছিল খুব । জগবন্ধু বাবুর স্ত্রী কিছুদিন থেকে নানা রকম অমুখে ভুগছিলেন । সেখানকার ডাক্তারকবিরাজের কিছু করতে না পারায় তাকে কলকাতায় নিয়ে আসবার কথা চলছিল। জগবন্ধু মতিলালকে লিখলেন একটা বাড়ী ভাড়া করবার কথা। বাড়ীর জন্য বেশী কষ্ট পেতে হ’ল না। তাদের বাড়ীর পাশেই একখানা বাড়ী খালি ছিল। সেই বাড়ীখানা জগবন্ধুবাবুদের জন্য ঠিক করা হ’ল। জগবন্ধু বাবুর পরিবার খুব বড় নয়। তার বুদ্ধা মা পুত্রবধুর সঙ্গে এলেন, আর এল মুমুধু মায়ের সেবার জন্ত কৃষ্ণ একাদশীর অস্তমান চন্দ্রের পাশে শুক্ল চতুর্দশীর পূর্ণশশীর মতন তার একমাত্র বিধবা মেয়ে হিমানী । জগবন্ধু বাবুর স্ত্রীকে মতিলাল মাসীমা বলে ডাকৃত । যেদিন তারা এসে পৌছলেন সেদিন থেকে মতিলালের আর বিশ্রাম নেই। এই ডাক্তারের বাড়ী ছোট, এই ডাক্তারখানায় যাওয়া, ঝি-চাকরের ব্যবস্থা করা, বাজার করা, রোগীর সেবা করা–একাই সে একশো হয়ে উঠল । আমরা তাদের বাড়ীতে গেলে মতিলালের মা হিমানীর মার উদ্দেশ্যে বলতেন—গেল-জন্মে মতিলাল বোধ হয় ওঁরই ছেলে ছিল । ছেলেটা এই সেদিন ব্যারাম থেকে উঠেছে, আবার না পড়লে বাচি । মতিলালের সঙ্গে-সঙ্গে হিমানীদের বাড়ীতে আমাদের গতিও অবারিত হয়ে উঠল। হিমানীর বাবার অগাধ কাজ। তাই তিনি সব সময়ে রুগ্ন স্ত্রীর কাছে থাকতে পারতেন না। দশ-পনেরে দিন অন্তর শনিবার দেখে তিনি কলকাতায় আসতেন আর রবিবার সন্ধ্যার সময় ফিরে যেতেন । মাস-কয়েক ধরে ডাক্তার, কবিরাজ, অবধূত ক’রে কিছুতেই হিমানীর মার অসুখ সারল না। এতদিন তবুও তিনি উঠতে-হাটতে পারছিলেন, কোথাকার এক দিগগজ কবিরাজ এসে দুটি-তিনটি গুলির আঘাতে ভদ্রমহিলাকে একেবারে বিছানায় পেড়ে ফেললে । আবার ডাক্তারী স্বরু হ’ল। পঞ্চাশ রকমের ওষুধ, মালিশ—ঘণ্টায় দু-তিনবার করে । তার ওপরে পনেরো মিনিট অন্তর জরের তাপ দেখা । খাতায় চৌকো ঘর কেটে তাতে জরের নক্সা করা, ইত্যাদি ব্যাপারে কাজ বেড়ে গেল চারগুণ। আমি আর নির্মল এসে হিমানী ও মতিলালকে সাহায্য করতে লাগলুম। কিন্তু আমাদের সেবা ও ডাক্তারদের চিকিৎসা সমস্ত ব্যর্থ ক’রে দিয়ে হিমানীর মা স্থির মৃত্যুর পথে এগিয়ে চলতে লাগলেন। ক্রমে তার অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হয়ে উঠল।