পাতা:প্রবাসী (ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৪৮৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

তরুণী ভাৰ্য্যা স্ত্রীসীতা দেবী বস্থবাড়ীর দোতলা, তিন তলা একরকম নিঝুম হইয়া আসিয়াছে। গরমের দিন, কিন্তু এখনও গ্রীষ্মের ছুটি আরম্ভ হয় নাই। ছেলেমেয়েদের মধ্যে যেগুলি বড় সেগুলি স্কুলে গিয়াছে। কৰ্ত্তার দুই ভাই, একজন গিয়াছেন কোটে, একজন গিয়াছেন কলেজে। উকীল-গৃহিণী বড় বউ তরু কোলের ছোট মেয়েটিকে লইয়া নিদ্রা দিতেছেন। তিন তলায় প্রফেসার-গৃহিণী মুক্তামাল, একটা নূতন ট্র্যাণ্ড ম্যাগাজিন লইয়া পাতা উন্টাইতেছেন। ঘুমে তাহারও চোখ চুলিয়া আসিতেছে, কিন্তু প্রতিজ্ঞ করিয়া বসিয়াছেন যে, আজ অন্তত: কোনোমতেই ঘুমাইবেন না। অনেকগুলি ছোটখাট শেলাই অৰ্দ্ধসমাপ্ত হইয়া পড়িয়া আছে, তাহা আর শেষ না করিলে চলে না। রোজ সকালে সঙ্কল্প করেন, দুপুরে নিশ্চয়ই শেলাই লইয়া বসিবেন, কিন্তু ভাত খাওয়ার পরেই শরীর ভার হইয়া ঘুমে চোখ ঢুলিয়া আসে, মনের সঙ্কল্প মনেই থাকিয়া যায়, ঘুমের কোলেই তিনি অঙ্গ ঢালিয়া দেন । ষ্ট্র্যাও ম্যাগাজিনটা তৃতীয়বার তাহার হস্তচু্যত হইয়া পড়িয়া গেল। তিনি চমকিয়া উঠিয়া বসিয়া সেট কুড়াইয়া লইলেন। একেবারে উঠিয়া পড়িয়া, শেলাইগুলি দেরাজ হইতে বাহির করিবেন কি না ভাবিতেছেন, এমন সময় বাহির হইতে কে যেন ডাকিল, “ছোটবহুম।” মুক্তামালা থাটের উপর সোজা হইয়া বসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে, রূপলাল নাকি ? কি চাস ?” বৃদ্ধ ভূত্য রূপলাল আস্তে আস্তে ঘরের ভিতর আসিয়া দাড়াইল । তাহার দুই চোখে জল, কাধের মলিন গামছা দিয়া সে ধার বার চোখ মুছিতেছে। অনেক দিনের চাকর সে, মুক্তামালার শাশুড়ীর আমল হইতে এ বাড়ীতে কাজ করিতেছে। জাতে হিন্দুস্থানী কাহার, কিন্তু প্রায় বাঙ্গালীরই মত বাংলা বলিতে পারে। এই বাড়ীই তাহার আপনার বাড়ী হইয়া উঠিয়াছে, বছরে একবার বাড়ী যায়, তাও সম্প্রতি সুরু করিষাছে। দেশে বুড়ী চাচী, এবং এক খুড়তুতো বোন ভিন্ন বিশেষ কেহই ছিল না। কাজেই চার পাচ বছর পরে পরে এক এক বার গিয়া দর্শন দিলে, এবং মাসে একখানা করিয়া ‘খং' লিখিলেই রূপলালের বিবেক শান্ত থাকিত। কিন্তু বছর চার হইল সে এক বিষম জালে জড়াইয়া পড়িয়াছে। বৃদ্ধ চাচীর হা হুতাশে, এবং পাড়া-প্রতিবেশীর কুপরামর্শে ভুলিয়া, বুড় বয়সে বহু অর্থব্যয়ে এক কিশোরীর পাণিপীড়ন করিয়া বসিয়াছে। এখন বছরে একবার করিয়া দেশে না গেলেই চলে না। বউয়ের নাম ঝুলনী, বয়স পনেরো, কি ষোলো। দেশেই সে থাকে, রূপলালের শাশুড়ীর অভিভাবকত্বে। রূপলালকে কাদিতে দেখিয়া, মুক্তামালা বিস্থিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি হল রে রূপলাল ? কাদছিল যে ? কেউ কিছু বলেছে নাকি ? বড়দি বকেছেন বুঝি ?” রূপলাল ভাঙা গলায় বলিল, “আমায় কে কি বলবে বহুম ? এ বাড়ীর সবাইকে আমি হতে দেখেছি, বড় বস্থমাকে সাদি দিয়ে এনেছি, আমাকে তিনি কি বকবেন ? অার বকবার মত কাজই বা আমি কি করি ?” মুক্তামালা বলিলেন, “তবে শুধু শুধু কাদছিল কেন ?” বৃদ্ধ বলিল, “দেশ থেকে ‘তার’ এসেছে বহুম, আমার চাচী মারা গেছে, আমার আজ রাতেই বাড়ী যেতে হবে", বলি আবার সে চোখ মুছিতে স্বরু করিল। মুক্তামাল৷ বলিলেন, “তা কেঁদে আর কি করবি বল ? বাপ মা, খুড়ে খুড়ী, কেই বা চিরদিন থাকে ? তোর খুড়ী ত তবু ঠিক বয়সে গিয়েছে, তোদের রেখে গিয়েছে। কত লোক অকালেই যায়। তা কবে ফিরবি ?” বৃদ্ধ বলিল, “চাচীর কাজ হয়ে গেলেই ফিরব, তার বেশী ছুটি কি আর বড়বছমা দেবেন ?”