পাতা:প্রবাসী (ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৫৪৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8సెVు প্রবাসী—শ্রাবণ, ১৩৩৭ ৩০শ ভাগ, ১ম খণ্ড তুলতে একটুও দ্বিধা করে না। একবার ভাবেও না যে, বুকভর স্নেহ নিয়ে, সামর্থ্যহীন নিরুপায় নারী কত যন্ত্রণ নীরবে সয়েছিল, কত দুঃখেই তার এ কাজ । বিশ্বস্বদ্ধ সবাই তর্জনী তুলে তাকে শাসন করে, কিন্তু যদিই অন্তর্যামী কেউ থাকেন, তাহ’লে হয়ত বা তিনি তার জন্যে ব্যথিতই হন, তারও হয়ত বা করুণার অশ্রুজলই ঝরে । و& নূতন কাপড়-জামা পরিয়ে, ছেলেমেয়ের মুখে মৃতন একটা আলোক, নূতন একটা হাসির দীপ্তি দেখে মমতার অনেক দিনের একটা ব্যথৰ্প আশা পূর্ণ হয়েছিল । তার আনন্দই হচ্ছিল। তবুও কি-একটা কাল মেঘ তার বুকের ভিতর এমন ঘনিয়ে এসেছিল যে, সে ভাল করে . কথা কইতেও পারছিল না। আজ নিয়ে দুদিন অনাথ বাড়ীতে অনুপস্থিত । অন্য সময় হ’লে তার উদ্বেগের আর সীমা থাকৃত না, আজ কিন্তু তার মনে হচ্ছিল, এ ভাল । সে এখন আরও খানিকটা না আসে যেন । অথচ মনে মনে স্বামীকে সে যে কি পৰ্য্যস্ত চাইছিল, তা নিজের অগোচর অন্তত: ছিল না । সারাদিন সে মুখ বুজে জীর্ণ বাড়ীখানির আগাগোড় ধোয়া-মোছা করল। যা যা জিনিষ অনাথ খেতে ভালবাসে পরিপাটি করে রাধলে । অর্থাভাবে এ-সাধ তার অনেক দিন পূর্ণ হয়নি। বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড় সাবান দিয়ে কেচে ধপধপে করে শয্যা পেতে রাখল। ছোট একখানি খাতায় খুচরা দেন শোধ, বাজার দেন শোধ, বাকী বাড়িভাড়া শোধ ইত্যাদি নানা ব্যয়ের হিসাব লিখে রাখল। একটা মোটা কাপড় জড়ান এক তাড়া নোট প্রায় দেড় হাজার টাকার, তারই উপর বড় বড় করে লিখল, “তোমার পিতৃঋণ শোধের জন্য !" এ ভালই হ’ল। সে তার প্রাণীপেক্ষ প্রিয়জনদের জন্য প্রাণাপেক্ষাও প্রিয় সন্ত্রম বলি দিয়েছে। নইলে যে তারা বাচত না । এ তার বড় রকমের আত্মহত্যা ! সে তার নারী-মহিমার ঘাড় মুচড়ে চিবদিনের মত তার মুখ বন্ধ করে দিয়েছে। আর এর পর হয়ত কোনীেদিন নিজের কোনে অন্যায় কাজেই সে বাধা দিতে পারবে না। সমস্ত গৃহ-কোণ জানাল দেয়াল কড়িকাঠ যেন আজ স্তন্ধ চোখে তার মুপের দিকে চেয়েছিল । অসীম মমতায় সে এই আত্মীয় স্বজনশূন্ত, শত দুঃখের নিলয়, শত ব্যথার স্মৃতি মাখানো বাড়িখানির প্রতি আগাগোড় বার বার চেয়ে দেখতে লাগল । তুলসীতলায় দীপ জেলে দিয়ে গলায় আঁচল দিয়ে প্রণাম করবার সময় বলল, “প্রভু এ অপরাধিনীকে তার যাবার দিনে তুমি মার্জন কোরে ।” ছেলেমেয়ে বার বার প্রশ্ন করতে লাগল, “কোথায় যাবে মা আজ ? কই তুমি কাপড় পরলে না ?” সে তাদের কি করে বোঝাবে যে এ যাওয়ার তার কত প্রয়োজন অথচ কত শক্ত! কত দুঃখ, কত ব্যথা, কত স্মৃতির ডোর ছিন্ন করা তা তারা কি বুঝবে ? এই শত পাকে জড়ান শত দুঃখের জীর্ণ বাড়িখানা, নিত্য অভাবরাক্ষসীর তাড়নাকে ছাড়তেও আজ তার দুঃখের অবধি ছিল না । রাত্ৰি হ’ল । সকল ঘরে আলো জেলে দিয়ে উঠানের মাঝে একটা আলে। রেখে সে অসীম স্নেহের চোথে এই বাড়িখানার ছাদ হতে নীচে পৰ্য্যস্ত দেখতে দেখতে কেঁদে ফেলল। এবাড়ি তার নিজের নয়। তার শ্বশুরেরও নয়। ভাড়া বাড়ি মাত্র । তবু এই বাড়িতেই সে প্রথম নববধূ রূপে পদার্পণ করেছিল। এটি তার ঘর। এই ঘরেরই পাশের ঘরে তার শ্বাশুড়ী মারা যান। শাশুড়ী মারা যাবার সময় তার হাত দুটি ধরে তিনি বলে গিয়েছিলেন, “বেীমা ! অনাথ আমার আজ সত্যিই অনাথ হ’ল। তুমি তাকে দেখো-শুনো। সে অন্যমনস্ক ভারি সরল, রোজগার করতে পারুক-না-পারুক তুমি তাকে গঞ্জনা দিও না । সংসার ঘাড়ে পড়লে আপনিই সব শিখবে । সে অকুরোধ সে একদিনও অবহেলা করেনি। একে একে সৰ্ব্বস্ব সে তাদের অনাথের হাতে তুলে দিয়েছে, তবু কোনো দিন মুখ ফুটে বলেও নি যে, “ওগে, রোজগার না করলে সংসার চলবে কেন ?