পাতা:প্রবাসী (ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৫৬৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বঙ্গসাহিত্যে প্যারীর্চদ শ্রীরামসহায় বেদান্তশাস্ত্রী বাঙ্গলার বর্তমান গদ্য-সাহিত্যের স্রষ্টা বলিয়া বঙ্কিমচন্দ্রকে আমরা পূজা করি । বঙ্গসাহিত্যের প্রকৃত অভু্যদয় বঙ্কিমচন্দ্র হইতেই হইয়াছে বলিয়া থাকি । কিন্তু এই সৃষ্টির মূলে র্যাহারা আছেন, এই অভু্যদয়ের পূর্ববর্তী হেতুরূপে র্যাহীদের নির্দেশ করা যায়, র্তাহাদিগকে ভুলিলে আমাদের চলিবে না । সে কাহারা ? রাজা রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয়চন্দ্র দত্ত, ও প্যারীচাঁদ মিত্র, অর্থাৎ টেকচাঁদ ঠাকুর। বঙ্কিমচন্দ্রের পূৰ্ব্বে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সংস্কৃত-বহুল ভাষাই বাঙ্গলার আদর্শ এবং শ্রেষ্ঠ ভাষ্য হইবে, ইহাই তখন লোকে ভাবিয়ছিল। সেই সংস্কৃত-বহুল ভাষাই ভদ্র ভাষা, সাহিত্যের ভাষা। ইহারই অনুসরণ করিয়া সে সময়কার বাঙ্গলার গদ্য ভাষা গড়িয়া উঠিতেছিল। সকল লেখকই এই ভাষা আশ্রয় করিয়া পুস্তক ও প্রবন্ধ রচনা আরম্ভ করিতেছিলেন, এই সংস্কৃত-বহুল ভাষার পরিবর্ভে যিনি সাধারণবোধ্য গ্রাম্যভাষা চালাইতে চাহিয়াছিলেন, বাঙ্গলার গদ্য ভাষাকে সম্পূর্ণ সংস্কৃতান্তবৰ্ত্তিতার আকর্ষণ হইতে মুক্ত করিবার জন্য যিনি উঠিয়৷ পড়িয় লাগিয়াছিলেন, তিনি প্যারীচাঁদ মিত্র বা টেকচাদ ঠাকুর । বাঙ্গলা ভাষা বাঙ্গলা ভাষা হইবে, অসুস্বার বিসর্গ হীন সংস্কৃত হইবে না, এই বলিয়া তিনি বিদ্রোহীর বেশে সাহিত্যের আসরে নামিয়াছিলেন। পুস্তক ও প্রবন্ধ রচনা করিয়া, ব্যঙ্গচিত্র আঁকিয় দল বাধিয়া উদ্দেশ্রসিদ্ধির জন্য সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করিয়াছিলেন। টেকচাদী ভাষা বা আলালী ভাষা সাহিত্যের ভাষা নতে, ভদ্রলোকের ভাষা নহে, শিক্ষিতের ভাষা নহে, উহা ছোটলোকের ভাষা এবং অপভাষা, এইরূপ বহু অপবাদ বহু গালাগালিই র্তাহাকে খাইতে হইয়াছিল। তথাপি তিনি উদ্দেশ্যভ্রষ্ট হন নাই। অসম সাহসে গন্তব্য পথে বিজয়ীর মতই চলিয়া গিয়াছেন ; পশ্চাতে ফিরেন নাই, সম্মুখের দিকে গতি আদৌ নিয়ন্ত্রিত করেন নাই । টেকচাদ ঠাকুর—এই ছদ্মনাম তাহাকে গ্রহণ করিতে হইয়াছিল। তাহা না করিয়া তাহার উপায়ও ছিল না। প্রথম সাহিত্যের ভিতর গ্রাম্যভাষা চালাইতে হইলে নিজের প্রকৃত নামের পরিবৰ্ত্তে ছদ্মনামেই অধিক কণয্য হইবে ভাবিয়াই তিনি ছদ্মনাম গ্রহণ করিয়|ছিলেন । ঐ সাহস তখনকার কালে অসম সাহস বলিয়াই বিবেচিত হইয়াছিল । বিদ্যাসাগর, অক্ষয় দত্ত ও ঈশ্বর গুপ্তের প্রভাবে প্রভাবিত দেশের অবস্থা, আর এখনকার বর্তমান অবস্থা এক নহে। বাঙ্গল ভাষা-সাধারণের বোধ্য হউক, প্রাণের ভাষা হউক, সংস্কৃতের নাগপাশে অাষ্টেপুষ্ঠে আবদ্ধ হইবে কেন, ইহাই ছিল তাহার অভিপ্রায় । সেই সময়ে তিনি বাঙ্গল ভাষাকে চলিত ভাষা করার চেষ্টা করিয়া গিয়াছিলেন বলিয়াই মধ্যযুগের সাহিত্যিকগণের পক্ষে মধ্যপথ ধরার বিশেষরূপ সুবিধাই হইয়াছিল । সংস্কৃতামুবত্তিতার প্রবল স্রোতকে তিনি বাধা না দিলে বর্তমান গদ্যসাহিত্যের উন্নতি আরও পিছাইয়া যাইত কি না কে জানে ? বিদ্যাসাগর, অক্ষয়চন্দ্র, ও এই প্যারীচাদের সংঘর্মের ফলেই আমরা এত শীঘ্র বঙ্কিমচন্দ্রকে পাইয়াছিলাম । প্যারীচঁাদ আলালী ভাষার স্রষ্ট বলিয়া তিনি যে সংস্কৃতবহুল ভাষা লিখিতেন না, বা লিখিতে জানিতেন না, এমন নহে। তখন যে-ভাষা সাহিত্যের ভাষা ও ভদ্রলোকের ভাষা ছিল, তাহাও তাহাকে প্রথম লিখিতে হইয়াছিল। প্যারীচাদের ভাষা হইতে আমরা এই নমুনা তুলিয়া দেখাইতেছি। বলিয়া রাখি যে, এই নমুনা আমাদের খুজিয়া বাহির করিতে হয় নাই। যে স্থানটি খুলিয়াছি, সেই স্থানটিতেই পাইয়াছি—