পাতা:প্রবাসী (ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৫৬৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

6२२ অবশ্ব ভ্রমর, স্বৰ্য্যমুখী, কুন্দ, আয়েষ, রজনী, দলনী, কমল ব। ইন্দিরার মত ফুটে নাই । একেবারে ফুটে নাই, তাহা বলিতে পারি না। এ চরিত্র ছায়ার মত চক্ষুর উপর ভাসে, প্রাণপ্রতিষ্ঠার দ্বার সজীব হইয়া হৃদয়ে গাঢ়রূপে অঙ্কিত থাকে না । কায়া আছে কিন্তু তাহার সাজসজ্জা নাই, প্রাণ অাছে কিন্তু তাহার স্পন্দন নাই। কতকগুলি বুক্ষের চার তৃণরাশির মধ্যে মাথা তুলিয়াছে, ফলফুলে ভরিয়া উঠে নাই। আজ সেই চারাগুলিই বঙ্গসাহিত্যের উদ্যানে পৃথক নাম ধরিয়া, সুন্দর বেশভূষা পরিয়৷ ফুলফলে ভরিয়া উঠিয়াছে । ংস্কৃত দুরূহ শব্দগুলির স্থানে যাহাতে বাঙ্গাল ভাষার নিজস্ব শব্দগুলি ব্যবহৃত হয়, সেদিকে তাহার বিশেষ দৃষ্টি ছিল। খয়ের ছাড়িয়া খদির, চিনি ছাড়িয়া শর্কর, কলা ছাড়িয়া রম্ভা, ঘি ছাড়িয়া ঘৃত প্রভৃতির ব্যবহার তিনি পছন্দ করিতেন না । বীপ, মা, দাদা, ভাই, বহিন, ঠাকুরুণ ও ভয়া প্রভৃতি ডাকই তাহার প্রিয় ছিল । র্তাহার উপম্বাসের নাম-করণেই তাহার অভিপ্রায় বুঝা যায়। কৰ্ত্ত জমিদারের নাম বাবুরাম। তাহার বন্ধুদের নাম বেচারাম ও বাঞ্ছারাম ; এমন কি ঠক্‌ চাচা ( মুসলমান বন্ধুটির নাম ) পৰ্য্যস্ত। নায়কের নামটি মতিলাল, তাহার ভ্রাতার নাম রামলাল । লাল কথাটি জুড়িয়া দেওয়ার মধ্যে ঐ একই উদেশ্বসিদ্ধি। প্যারীচাদের স্থই পুরুষ-চরিত্রগুলির কোনোটি অবশু গোবিন্দলাল, নগেন্দ্রনাথ, চন্দ্রশেখর, প্রতাপ, নবকুমার, ব্রজেশ্বর, সত্যানন্দ বা জগৎসিংহের মত হয় নাই । সাধারণতঃ ইহার চরিত্রগুলি যেন অৰ্দ্ধশিক্ষিত, অৰ্দ্ধমার্জিত, অৰ্দ্ধসভ্য, ও কথঞ্চিৎ গ্রাম্যভাবাপন্ন | র্যাহাকে ভাল করিয়াও অ কিয়াছেন, তিনিও বর্তমান যুগের বর্তমান ভাবে অকুপ্রাণিত হইয় গড়িয়া উঠেন নাই । প্যারীচাদ বাঙ্গালীকে বাঙ্গালী সমাজের খাট বাঙ্গালীই করিয়াছেন। তাহার মধ্যে অবশ্য তেমন সৌন্দৰ্য্য-স্বষ্টি করিতে পারেন নাই । আবার তাহাদের বিদেশীয় করিয়াও গড়িয়া তোলেন নাই। বাঙ্গালায় মাত, পিত:, ভ্রাতঃ প্রভৃতি সম্বোধনগুলি তিনি দেখিতে পারিতেন না। দ্বাঙ্গালী প্রবাসী—শ্রাবণ, ১৩৩৭ [ ৩০শ ভাগ, ১ম খণ্ড নরনারী সাধুভাষায়, কাব্যের ভঙ্গীতে এবং ইংে আদবকায়দায় কথা কহিবে, ইহা তিনি ভালবাসিতেন ন। স্ত্রীকে গিনী, শাশুড়ীকে ঠাকরুণ, বন্ধুদের কাহাকেও বেণী ভায়, কাহাকেও বেচারাম-দাদা এইরূপ সম্বোধন পদই ব্যবহার করিয়াছেন । প্যারীচঁাদ প্যারীচাঁদই ছিলেন । টেকচাঁদ ঠাকুরই তাহার যথার্থ পরিচয়। বিদ্যাসাগর বা অক্ষম্প্রদত্ত মহাশয়ের কার্য্য এক, তাহার কার্য্য পৃথক । তাহার “আলালের ঘরের দুলাল”-এর যথার্থ পরিচয় দিতে হইলে বা তাহার প্রকৃত বিচার করিতে হইলে, সেই সময়কার দেশ কাল অবস্থা বিবেচনা করিতে হইবে। জঙ্গলের মধ্যে উদ্যানের সৌন্দর্য্য অন্বেষণ করিলে চলিবে না। “অলালের ঘরের দুলাল” সম্বন্ধে বঙ্কিমচন্দ্ৰ যাহা লিখিয়াছেন, তাহাই পাঠকগণকে শুনাইয়া এই প্রবন্ধ শেষ করিব । আলালের ঘরের দুলাল’ বাঙ্গল ভাষায় চিরস্থায়ী ও চিরস্মরণীয় হইবে। উহার অপেক্ষ উৎকৃষ্ট গ্রন্থ তৎপরে কেহ প্রণীত করিয়া থাকেন অথবা কেহ ভবিষ্যতে করিতে পারেন, কিন্তু আলালের ঘরের জুলালের দ্বারা বাঙ্গল সাহিত্যের যে উপকার হইয়াছে, আর কোন বাঙ্গল গ্রন্থের দ্বারা সেরূপ হয় নাই। ভবিষ্যতে হইবে কিনা সন্দেহ । বাঙ্গলা গদ্য যে উন্নতির পথে যাইতেছে, প্যারীচাদ মিত্র তাহার প্রথম ও প্রধান কারণ, ইহাই তাহার অক্ষয় কীৰ্ত্তি।” (প্যারীচঁাদ মিত্রের গ্রন্থাবলীর ভূমিকা ) বঙ্গসাহিত্য এখন উন্নতির পথে গিয়া চরম পরাকাষ্ঠা লাভ করিয়াছে। র্তাহার যোগ্য সম্মান দিবার উপযুক্ত সময় আমাদের মনে এখনই আসিয়াছে। র্তাহার বিদ্রোহ এক নূতন রাজ্য গড়িয়া তুলিয়াছে। র্তাহার উদ্যম জয়যুক্তই হইয়াছে। প্যারীচঁাদ মিত্র সত্যসত্যই যে একজন অন্যতম যুগপ্রবর্তক মহাপুরুষ, তাহাতে আর সন্দেহ মাত্র-নাই ।*

  • বঙ্কিম-সাহিত্য-সন্মিলনে পঠিত।