পাতা:প্রবাসী (ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৫৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

১ম সংখ্যা ] ভাইফেঁটী নাই। ছেলেটিও কি মনে করিয়া শশির দিকে একবার চাহিয়া দেখিল । তাহার মুখে গভীর হতাশা এমনভাবে ফুটিয়া উঠিয়াছিল যে, যুবক কিঞ্চিং বিস্মিতভাবে সিড়িতেই দাড়াইয় পড়িল । শশিমুখীকে এবং কুন্তীকে সে প্রায়ই দেখে । দোতলার গিন্নির কাছে ইহাদের পরিচয়ও সে খানিক খানিক পাইয়াছে। সে নিজে দারিদ্র্যের নিষ্পেষণ কি রকম তাহা ভাল করিয়াই অনুভব করিয়াছে, কাজেই অপরিচিত হইলেও শশিমুখীর প্রতি তাহার সহানুভূতি অনেকখানিই ছিল । শশিমুখী তাহাকে দাড়াইয়া থাকিতে দেখিয় একটু যেন বিরক্তভাবেই জিজ্ঞাসা করিল, “কি চাই আপনার, আমরা মিষ্টি কিন্ব না।” যুবক কিঞ্চিৎ অপ্রতিভ হইয়া বলিল, “সে জন্যে আমি দাড়াইনি, মা । আপনাকে বড় অসুস্থ দেখাচ্ছে, তাই মনে করলাম আমি যদি কিছু সাহায্য করতে পারি।” শশিমুখীর চোখে জল আসিয়া পড়িল । দুঃখ দুর্ভাবনায় সে অভ্যস্ত, কিন্তু সহানুভূতি জিনিষটা তাহার কাছুে নূতন। স্বামী স্ত্রী দুজনেই এত অবসন্ন, ম্ৰিয়মাণ তাহার, যে, পরস্পরকে একটু সাত্বনা দিবার ক্ষমতাও আর তাহাদের অবশিষ্ট নাই । অটল ভাবে, স্ত্রী ইচ্ছা করিয়া তাহার সাহায্য করে না ; শশিমুখী ভাবে, ইহার হাতে পড়িয়া আমার দুঃখ-দুৰ্গতির অস্ত রহিল না, এ আবার আমার কাছে আশা করে কি ? দুজনের মনে দুজনের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নাই, তাহদের ভালবাসাও যেন এই আবর্জনার স্তপের নীচে চাপা পড়িয়া গিয়াছে। তাই হঠাৎ এই অপরিচিতের মুখে সমবেদনার বাণী শুনিয়া সে আর আত্মসংবরণ করিতে পারিল না । কোনোমতে গলাটা একটু পরিষ্কার করিয়া বলিল, “ন। বাবা, আমার সাহায্য এক ভগবান ছাড়া কেউ করতে পারে না। মানুষের ক্ষমতার অতীত হয়ে গেছে ।” যুবক সিড়ি কয়টা নামিয়া শশিমুর্থীর সামনে আসিয়া দাড়াইল। তাহার পর বলিল, “মা, আপনি আমাকে চেনেন না, আমিও আপনাকে চিনি না। কিন্তু আপনাকে দেখে আমি নিজের গত জীবনটাকেই আবার ാണജ്ഞ. যেন দেখতে পাচ্ছি। একদিন আমিও ভেবেছিলাম দেবতা, মানুষ, আমাকে আর কেউ বাচাতে পারবে না, . নিজের প্রাণ নিজেই নিতে গিয়েছিলাম । কিন্তু দেখছেন ত, বেঁচেই আছি, করে খাচ্ছি। ভদ্রলোক হবার বালাই ঘুচে গেছে, কিন্তু মানুষ হতে পেরেছি, মা । আপনাকে ম৷ ব’লে ডাকছি বটে, কিন্তু বয়সে আপনি আমার ছোটই হবেন। আমায় দেখে বুঝুন, হাল ছাড়তে নেই কখনও, যতই দুর্দশা হোক, তার থেকে বেরিয়ে আসবার পথ একট-না-একটা থাকেই ।” শশিমুখী বলিল, “চোখে ত কিছু দেখতে পাই না। স্বামীর একশ টাকা মাইনের চাকরী সম্বল করে, ছেলেমেয়ে নিয়ে, আধপেট থেয়ে, ছেড়া কাপড় পরে, এই গৰ্ত্তের মধ্যে দিন কাটাচ্ছি। সেই চাকরীও ঋণের দায়ে যেতে বসেছে। আমাদের আর উপায় কি ?” যুবক বলিল, “ঋণ অল্পে অল্পে শোধ করবার কি কোনো উপায় নেই ? বুঝিয়ে বললে সব পাওনাদারেই কথা শোনে ৷” শশিমুখী বলিল, “ঐ একশ থেকে কি খেয়ে কি দেব ? কলকাতার খরচ জানেন ত ? তার উপর চারটি প্রাণী আমরা, ছেলের আবার নিত্যি রোগ লেগে অাছে।” শশিমুখী একটু মন খুলিয়৷ কথা বলিতে পাইয়া যেন বাচিয়া গিয়াছিল, তাহার আর কোনো সঙ্কোচ ছিল না । যুবক বলিল, “আয় বাড়াবার চেষ্ট করুন। আপনিও ত কিছু কিছু উপার্জন করতে পারেন।” শশিমুখী বলিল, 4আমি কোথা দিয়ে কি করব বাবা ? হিন্দুঘরের মেয়ে, বি-এ, এম-এ, পাশ করিনি কিছু, যে চাকরী করে টাকা আনব। স্কুলে কয়েক ক্লাশ পড়েছি মাত্র। তাও যদি দু-দশটাকা কেউ দিতে চায়, তা আমার এ জেলখানা ছেড়ে নড়বার জো কই ? বড় মেয়ে ঘরে, রোগা ছেলেটাও রয়েছে, না হলে রাধুনীর কাজ পেলেও নিতাম।” যুবক বলিল, “ম, উপায় ঢের আছে । আজ আমার সময় নেই, অহুমতি করেন ত কাল এই সময় আবার আসব। আমার বিশ্বাস আমার কথামত চল্‌লে আপনাদের সাহায্য হবে । আচ্ছা এখন তবে আসি, নমস্কার ।”