পাতা:প্রবাসী (ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৬৮৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

প্রয়াগের চিঠি ঐযতীন্দ্রকুমার ভৌমিক সূৰ্য্যদেব অস্তাচলের অন্তরালে ঢলিয়া পড়িয়াছিলেন । সন্ধ্যার তিমিরাবরণে চারিদিক ধীরে ধীরে আচ্ছন্ন হইয়া আসিতেছিল । দিনের শেষরশ্মি তখনও আকাশের গা হইতে সম্পূর্ণ মুছিয়া যায় নাই। কৃষ্ণবিহার ক্লান্ত পদবিক্ষেপে, শুষ্ক অপ্রসন্নমুখে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়া কাহাকেও দেখিতে না পাইয়া মনে মনে অত্যন্ত চটিয়া গেলেন। হাতের পুটুলিটি রকের একপার্থে ফেলিয়া রাখিয়া ক্রুদ্ধকণ্ঠে ডাকিলেন, “লতি! লতি! দেখদিকি কাগুটী একবার । এই ভরসন্ধ্যে,—এর সব গেল কোথায় ?” পথ হইতে স্বামীর ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর স্বরবালার কানে গেল। তাড়াতাড়ি কলসীকক্ষে বাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করিয়া তিনি ঝঙ্কার দিয়া বলিয়া উঠিলেন, “কেন, হ’ল কি তোমার ? টেঢ়িয়ে পাড়াস্থদ্ধ যে একেবারে তোলপাড় করে তুলেছ ?” কৃষ্ণবিহারী বলিলেন, “সন্ধ্যে উৎরে গেল, তবু বাড়ীতে পিণীমটা পৰ্য্যন্ত জললো না।” স্বরবাল জলের কলসীট রান্নাঘরের বারান্দায় নামাইয়া রাখিয়া আর একটু স্থর চড়াইয়া বলিলেন, “এই ত কেবল পুকুরের ঘাটে জল জানতে গিয়েছি।” ভোরের কুয়াস যেমন হুর্য্যোদয়ে অস্তহিত হইয়া যায়, কৃষ্ণবিহারীর ক্রোধের উত্তাপও তেমনি স্বরবালার এক ফুৎকারে শীতল হইয়া আসিল । তিনি আর কোনো কথা না বলিয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিলেন। স্বরবালা সন্ধ্যাপ্রদীপ জালিতে জালিতে বলিলেন, “নাও, ঐ ঘটিতে জল আছে, হাত প; ধোও এখন।" কৃষ্ণবিহারী ঘটট লইয়া চোখে মুখে জল দিয়া বলিলেন, “লতি গেল কোথায়, লতি ? পাড়া বেড়িয়ে এখনও ফেরেনি বুঝি ? না, এদের জালায়—” স্বরবালা তখন তুলসীতলায় প্রদীপ দিয়া প্ৰণাম করিতেছিলেন । তাড়াতাড়ি উঠিয়া দাড়াইয়া বলিলেন, “এই আবার বকুনি আরম্ভ হ’ল । ফেরেনি, ফেরেনি । তাতে তোমার কি ?” কৃষ্ণবিহারী ভ্ৰ কুঞ্চিত করিয়া বলিলেন, “দেখ, ছেলেমেয়েদের আমন আস্কার দেওয়া মোটেই ভাল নম্ব।” স্বরবালা স্বামীর মুখের কাছে হাত নাড়িয়া বলিলেন, “ভাল না হয়, মন্দই হবে। তাতেই বা কি ? তুমি ত একবার ভাল হয়ে কত কি করলে ?” *. কত কি তিনি করিয়াছেন, না করিয়াছেন, সে কথা লইয়া আর কথা না বাড়াইয়া কৃষ্ণবিহারী হ কাটি লইয়। আপন মনে তামাক সাজিতে বসিয়া গেলেন । স্বরবালা ক্ষণকাল স্বামীর শুষ্ক আনত মুখখানার পানে চাহিয়া থাকিয়া বলিলেন, “আজ দুপুরে এলে না যে ? খাওয়া-দাওয়া করলে কোথায়?” কৃষ্ণবিহারী মুখ হইতে হু কাটা সরাইয়া বলিলেন, "খাওয়া-দাওয়া আবার কোথায় হবে ?” "একটু জলটলও খাওনি ?” “সে না খাওয়ার মধ্যেই। নিতাই ছোড়াটা ঐ কুবরে ব্যাটার দোকান থেকে ছপয়সার চিড়ে-মুড়কি এনে দিয়েছিল ; রাম হে, সে কি খাওয়া যায় ?”—বলিয়া হু কায় একটা টান দিয়া কৃষ্ণবিহারী বলিলেন, “এমন কাজের চাপও পড়েছে আজকাল । সকাল বেলায় হরেনকে ডেকে বললাম, আরে! কাছারীর দিকে যাস্ত একবার। গিয়ে—” স্বরবালা মহা বিরক্তিভরে বলিয়া উঠিলেন, "না, তোমার আর বুদ্ধিমুদ্ধি হ’ল না। বিয়ের বাজারে দু’পয়সা পাওয়া যেত, সে আর তুমি হতে দিলে না দেখছি।”—বলিয়া লুষ্ঠিত অঞ্চলটা উঠাইয়া লইয়া বলিলেন, “তাই যদি হবে, তাহলে ওকে লেখাপড়া শিখিয়েছি কি জন্তে ? বি-এ পাশ ছেলে আমার—”