পাতা:প্রবাসী (ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৭৩০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বাংলা ভাষায় গদ্য লিখতে নতুন শব্দের প্রয়োজন প্রতিদিনই ঘটে। অনেক দিন ধ’রে অনেক রকম লেখা লিখে এসেছি। সেই উপলক্ষ্যে অনেক শব্দ আমাকে বানাতে হ’ল। কিন্তু প্রায়ই মনের ভিতরে খটকা থেকে যায়। সুবিধা এই যে, বার বার ব্যবহারের দ্বারাই শব্দবিশেষের অর্থ আপনি পাকা হয়ে ওঠে, মূলে যেটা অসঙ্গত, অভ্যাসে সেটা সঙ্গতি লাভ করে। তৎসত্ত্বে সাহিত্যের হট্টগোলে এমন অনেক শব্দের আমদানি হয়, যা ভাষাকে যেন চিরদিনই পীড়া দিতে থাকে। যেমন সহানুভূতি । এটা symnathy শব্দের তর্জমা । ‘সিম্প্যাথি’-র গোড়াকার অর্থ ছিল দরদ । ওটা ভাবের আমলের কথা, বুদ্ধির আমলের নয়। কিন্তু ব্যবহারতঃ ইংরেজীতে সিম্প্যাথির মূল অর্থ আপন ধাতুগত সীমা ছাড়িয়ে গেছে। তাই কোনো একটা প্রস্তাব সম্বন্ধেও সিম্প্যাখি-র কথা শোনা যায়। বাংলাতেও আমরা বলতে আরম্ভ করেছি—‘এই প্রস্তাবে আমার সহানুভূতি আছে । বলা উচিত, ‘সন্মতি আছে, বা ‘আমি এর সমর্থন করি । যাই হোক্—সহানুভূতি কথাটা বে বানানো কথা এবং ওটা এখনো মানান-সই হয়নি, তা বেশ বোঝা যায়—যখন ও শব্দটাকে বিশেষণ করবার চেষ্টা করি। সিম্প্যাথিটিক্-এর কী তর্জমা হতে পারে, সহানুভোঁতিক, বা সহানুভূতিশীল’, বা সহানুভূতিমান ? . ভাষায় যেন খাপ খায় ন—সেই জন্তেই আজ পর্য্যন্ত বাঙালী লেখক এর প্রয়োজনটাকেই এড়িয়ে গেছে। দরদের বেলা দরদী’ ব্যবহার করি, কিন্তু সহানুভূতির বেলায় লজ্জার চুপ ক’রে যাই। অথচ সংস্কৃত ভাষায় এমন একটি শব্দ আছে, যেটা একেবারেই তথার্থক । সে হচ্চে ‘অনুকম্পা’ । ধ্বনিবিজ্ঞানে ধ্বনি ও বাদ্যযন্ত্রের তারের মধ্যে সিম্প্যাথি-র কথা শোনা যায়---যে সুরে বিশেষ কোনো তার বাধা, সেই সুর শদিত হ’লে সেই তারটি অমুকম্পিত ও 'অমুধ্বনিত হয়। এই ত ‘অনুকম্পন’ । অস্তের বেদনায় যখন আমার চিত্ত ব্যথিত হয়, তখন সেই ত ঠিক ‘অনুকম্পা’ । 'অমুকম্পায়ী’ কথাটা সংস্কৃতে আছে। ‘অমুকম্পাগ্রবণ’ শব্দটাও মন্দ শোনায় না। অনুকম্পালু বোধ করি ভালোই চলে।. মুক্ষিল এই যে, দখলের দলিলটাই ভাষায় স্বত্বের দলিল হয়ে ওঠে। কেবলমাত্র এই কারণেই ‘কান, সোনা, চুন, পান’ শব্দগুলোতে মুৰ্দ্ধন্ত ণ-য়ের অনধিকার নিরোধ করা এত দুঃসাধ্য হয়েচে । ছাপাখানার অক্ষর-যোজকের সংশোধন মানে না। তাদের প্রশ্ন করা যেতে পাৰ্বত যে, কানের এক সোনায় যদি মুৰ্দ্ধন্ত ৭ লাগল, তবে অন্ত শোনায় কেন দন্ত্য ন লাগে। শ্রবণ" শব্দের রফলা লোগ হবার সঙ্গে সঙ্গে তার মুৰ্দ্ধস্ত ৭ সংস্কৃত ব্যাকরণ মতেই দস্ত্য ন হয়েচে। অথচ ‘স্বর্ণ শব্দ যখন রেফ বর্জন কয়ে ‘সোনা হ’ল, তখন মুৰ্দ্ধস্ত শ-য়ের । বিধান কোন মতে হয় ? হাল আমলের নতুন সংস্কৃত পোড়োর 'সোনা’কে শোধন করে নিয়েচেন, তাদের স্বকল্পিত ব্যাকরণবিধির " স্বারা। এখন দখল প্রমাণ ছাড়া স্বত্বের অন্ত প্রমাণ অগ্রাহ হয়ে গেল । ‘শ্রবণ” শব্দের অপভ্রংশ শোনা শব্দ যখন বাংলা ভাষায়:বানান-দেহু ধারণ করেছিল, তখন বিদ্যাসাগর প্রভৃতি প্রাচ পণ্ডিতেরা বিধানকর্তা ছিলেন—সেদিনকার বানানে কান সোনা প্রভৃতিরও মূৰ্দ্ধস্তত্ব প্রাপ্তি হয়নি। কিছুকাল পূৰ্ব্বে যখন ভারতশাসনকৰ্ত্তারা ইন্টার্ন স্বর করলেন, তখন খবরের কাগজে তাড়াতাড়ি একটা শব্দ সৃষ্টি হয়ে গেল‘অন্তরীণ। শৰাসাদৃষ্ঠ ছাড়া এর মধ্যে আর কোনো যুক্তি নেই। বিশেষণে ওটা কী হতে পারে, তাও কেউ ভাবলেন না। Externmont-কে কি বলতে হবে বহিরীণ ? অথচ অন্তরায়ণ, অন্তরায়িত, বহিরায়ণ, বহিরায়িত ব্যবহার করলে আপত্তির কারণ থাকে না, সকল দিকে সুবিধাও ঘটে । নুতন সংঘটিত শব্দের মধ্যে কদৰ্য্যতায় শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছে বাধ্যতামূলক শিক্ষা। প্রথমতঃ শিক্ষার মূলের দিকে বাধ্যতা নয়, ওটা শিক্ষার পিঠের দিকে। বিদ্যাদান বা বিদ্যালাভই হচ্চে শিক্ষার মুলে—তার প্রণালীতেই কম্পাল্শন’। অথচ অবশু-শিক্ষা শব্দটা বলবামাত্র বোঝা যায় জিনিষটা কি। দেশে, অবশু-শিল্প প্রবর্তন করা উচিত—কানেও শোনায় ভালো, মনেও প্রবেশ করে সহজে । ‘কম্পাল্দারি এডুকেশন-এব বাংলা যদি হয় বাধ্যতামূলক শিক্ষা, ‘কম্পালুসারি সাবজেক্ট কি হবে বাধ্যতামূলক পাঠ্য-বিষয় ? তার চেয়ে অবঙ্গা-পাঠ্য বিষয়", কি সঙ্গত ও সহজ শোনায় না? ঐচ্ছিক’ (optional) শব্দটা সংস্কৃতে পেয়েছি, তারি প্রতিবর্গে 'আবস্তিক’ শব্দ ব্যবহার চলে কি না, পণ্ডিতদের জিজ্ঞাসা করি। ইংরেজীতে যে সব শৰা অত্যন্ত সহজ ও নিত্য প্রচলিত, দরকারের সময় বাংলায় তার প্রতিশব্দ সহসা খুজে পাওয়া যায় না, তখন তাড়াতাড়ি যা হয় একটা বানিয়ে দিতে হয় । সেটা অনেক সময় বেখাপ হয়ে দাড়ায়, অনেক সময় মূল ভাবটা ব্যবহার করাই স্থগিত থাকে। অথচ সংস্কৃত ভাষায় হয় ত তার অবিকল বা অমুরূপ ভাবের শব্দ দুলৰ্ভ নয়। একদিন রিপোর্ট" কথাটায় বাংলা করবার প্রয়োজন হয়েছিল। সেটাকে বানাবার চেষ্টা করা গেল, কোনটাই মনে লাগল না। হঠাৎ মনে পড়ল কাদম্বরীতে আছে ‘প্রতিবেদন’---আর ভাবনা রইল না। 'প্রতিবেদন, প্রতিবেদিত, প্রতিবেদক?--যেমন ক’রেই ব্যবহার করে, কানে বা মনে কোথাও বাধে না । জনসংখ্যার অতিবৃদ্ধি---ওভারপপুলেশন’---বিষয়টা আজকাল খবরের কাগজের একটা নিত্য আলোচ্য ; কোমর বেঁধে ওর একটা বাংলা শব্দ বানাতে গেলে ইপিয়ে উঠতে হয় ---সংস্কৃত শব্দকোযে তৈরি পাওয়৷ যায়, “অতিপ্ৰজন । বিদ্যালয়ের ছাত্র সম্বন্ধে 'রেসিডেন্ট’, ‘ননরেসিডেন্ট’ বিভাগ করা দরকার, বাংলায় নাম দেবো কি ? সংস্কৃত ভাষায় সন্ধান করলে পাওয়া যায় আবাসিক', অনাবাসিক’ ।... (সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা, ১৩৩৬) শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর য়ুরোপীয় সভ্যতা বস্তু কি ? য়ুরোপীয় সভ্যত বস্তু কি ?—এপ্রশ্ন আজকাল যুরোপীরেরাও জিজ্ঞাসা করতে আরম্ভ করেছেন।•••য়ুরোপের গত যুদ্ধ সে দেশের লোকের আত্মপ্রসাদের স্বখশ্বপ্ন ভাঙিয়ে দিয়েছে। উক্ত যুদ্ধের প্রবল ধাক্কার