পাতা:প্রবাসী (ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৭৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পঞ্চাশোৰ্দ্ধমৃ পঞ্চাশ বছরের পরে সংসার থেকে স’রে থাকার জন্য মনু আদেশ করেছেন । যাকে তিনি পঞ্চাশ বলেচেন, সে একটা গণিতের অঙ্ক নয়, তার সম্বন্ধে ঠিক ঘড়িধর হিসাব চলে না। ভাবখান এই যে, নিরস্তর পরিণতি জীবনের ধৰ্ম্ম নয়। শক্তির পরিব্যাপ্তি কিছুদিন পর্য্যস্ত এগিয়ে চলে, তার পরে পিছিয়ে আসে । সেই সময়টাতেই কৰ্ম্মে যতি দেবার সময় ; না যদি মানা যায়, তবে জীবযাত্রার ছন্দোভঙ্গ হয়। জীবনের ফসল সংসারকে দিয়ে যেতে হবে। কিন্তু যেমন-তেমন ক’রে দিলেই হলো না । শাস্ত্র বলে, শ্রদ্ধয় দেয়: ; যা আমাদের শ্ৰেষ্ঠ, তাই দেওয়াই শ্রদ্ধার দান ; সে ন কুঁড়ির দান, না ঝরা ফুলের । ভরা ইন্দারায় নিৰ্ম্মল জলের দক্ষিণা, সেই পূর্ণতার সুযোগেই জলদানের পুণ্য ; দৈন্য যখন এসে তাঁকে তলার দিকে নিয়ে যায়, তখন যতই টানাটানি করি ততই ঘোলা হয়ে ওঠে ।... যে-কাজটা নিজের অস্তরের ফরমাসে, তা নিয়ে বাহিরের কাছে কোন দায় নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সাহিত্যে বাহিরের দাবী দুৰ্ব্বার । যে-মাছ জলে আছে তার কোনো বালাই নেই, যে-মাছ হাটে এসেছে তাকে নিয়েই মেছোবাজার । সত্য ক’রেই হোক, ছল করেই হোক, রাগের ঝণঝে হোক, অমুরাগের বাথায় হোক, যোগ্য ব্যক্তিই হোক, অযোগ্য ব্যক্তিই হোক, যে-সে, স্পন-তপন, যাকে-তাকে. বলে উঠতে পারে, তোমার প্রদের জোগান ক’মে আসচে, তোমার রূপের ডালিতে রঙের রেশ ফিকে হয়ে এল ;–তর্ক করতে যাওয়া বৃথা ; কারণ, শেষ যুক্তিটা এই যে, আমার পছন্দ মাফিক হচ্চে না। তোমার পছন্দের বিকার হ’তে পারে, তোমার স্বরচির অভাল থাকতে পারে, এ কথা বলে লাভ নেই। কেন না, এ হ'লে রচির বিরুদ্ধে রচির তর্ক, এ তর্কে দেশকালপাত্রবিশেষে কটুভাষার পঙ্কিলত মথিত হয়ে ওঠে, এমন অবস্থায় শাস্তির কট্ত্ব কমাবার জন্তে সবিনয় দানত স্বীকার ক'রে বল ভাল যে, স্বভাবের নিয়মেই শক্তির ত্বাদ ; অতএব শক্তির পূর্ণত কালে যে উপহার দেওয়া গেছে, তারই কথা মনে রেখে, অনিবাৰ্য্য অভাবের সময়কার ত্রুটি ক্ষমা করাই সৌজন্যের লক্ষণ । শ্রাবণের মেঘ আশ্বিনের আকাশে বিদায় নেবার বেলায় ধারাবর্ষণে যদি ক্লাস্তি প্রকাশ করে তবে জনপদবধুরা তাই নিয়ে কি তাকে সুয়ে৷ দেয় ? আপন নবখ্যামল ধানের ক্ষেতের মাঝপানে দাড়িয়ে মনে কি করে না, আষাঢ়ে এই মেঘেরই প্রথম সমাগমের দক্ষিণ সমারোহের কথা ? কিন্তু মাশচর্য্যের বিষয় এই যে, সাহিত্যের ক্ষেত্রেই এই সেীঞ্জস্থ্যের দাবী প্রায় ব্যর্থ হয়। বৈষয়িকক্ষেত্রেও পুৰ্ব্বকৃত কৰ্ম্মের প্রতি কৃতজ্ঞতার ভদ্রীতি আছে। পেনশনের প্রথা তার প্রমাণ। কিন্তু সাহিত্যেই পুর্বের কথা স্মরণ করে শক্তির হ্রাস ঘটাকে অনেকেই ক্ষমা ক’রতে চায় না। এই তীব্র প্রতিযোগিতায় দিনে অনেকেই এতে উমাস অমুম্ভব করে। কষ্টকল্পনার জোরে হালের কাজের ক্রটি প্রমাণ ক’রে সাবেক কাজের মূল্যকে “খৰ্ব্ব করবার জন্তে তাদের উত্তপ্ত আগ্রহ ••• জীবনের পচিশ বছর লাগে কৰ্ম্মের জন্তে প্রস্তুত হ’তে, কাচা হাতকে পাকাবার কাজে । তারপরে পচিশ বছর পূর্ণশক্তিতে কাজ করবার সময়। অবশেষে, ক্রমে ক্রমে, সেই কর্মের বন্ধন থেকে মুক্তি নেবার জন্তে আরো পচিশ বছর দেওয়া চাই। সংসারের পুরোপুরি দাবী মাঝখানটাতে, আরস্তেও নয়, শেষেও নয়। এই ছিল আমাদের দেশের বিধান। কিন্তু পশ্চিমের নীতিতে কৰ্ত্তব্যটাই শেষ লক্ষ্য, যে-মানুষ কৰ্ত্তব্য করে সে নয়। আমাদের দেশে কৰ্ম্মের যন্ত্রটাকে স্বীকার করা হয়েচে, কৰ্ম্মীর আয়াকেও । সংসারের জন্যে মানুষকে কাজ করতে হবে, নিজের জন্যে মানুষকে মুক্তি পেতেও হবে । কৰ্ম্ম করতে ক’রতে কৰ্ম্মের অভ্যাস কঠিন হ’য়ে ওঠে এবং তার অভিযান । এক সময়ে কৰ্ম্মের চলতি স্রোত আপন বালির বাধে আপনি বাধে, আর সেই বন্ধনের অহঙ্কারে মনে করে সেই সীমাই চরম সীমা, তার উৰ্দ্ধে আর গতি নেই ••• সংসারে যত কিছু বিরোধ—এই সীমায় সীমায় বিরোধ, পরস্পরের বেড়ার ধারে এসে লাঠালাঠি । এইখানেই যত ঈর্ষা, বিদ্বেষ ও চিত্তবিকার । এই কলুষ থেকে সংসারকে রক্ষা করবার উপায় কৰ্ম্ম হ’ঙ্গে বেরিয়ে পড়বার পথকে বাধামুক্ত রেখে দেওয়া। সাহিত্যে একটা ভাগ ঙ্গাছে, যেখানে আমরা নিজের অধিকারে কাজ করি, সেখানে বাহিরের সঙ্গে সংবাত নেই। অার একটা ভাগ অাছে, যেখানে সাহিত্যের পণ্য আমরা বাহিরের হাটে অগনি, সেইখানেই হট্টগোল। একটা কথা স্পষ্ট বুঝতে পারচি, এমন দিন আসে, যখন এইখানে গতিবিধি যথাসম্ভব কমিয়ে আনাই ভালো, নইলে বাইরে ওড়ে ধুলোর ঝড়, নিজের ঘটে অশাস্তি, নইলে জোয়ান লোকদের কনুইয়ের ঠেলা গায়ে পড়ে পাজরের উপর অত্যাচার করতে থাকে । সাহিত্যলোকে বাল্যকাল থেকেই কাজে লেগেছি । আরম্ভে খ্যাতির চেহারা অনেক কাল দেপিনি। তখনকার দিনে প্যাতির পরিসর ছিল অল্প, এই জন্যই বোধ করি, প্রতিযোগিতার পরুষতা তেমন উগ্র ছিল না। আত্মীয়-মহলে যে কয়ঙ্গম কবিব লেখা সুপরিচিত ছিল, তাদের কোনোদিন লঙ্ঘন করবো বা করতে পারবো, এমন কলা মনেও করিনি । তখন এমন কিছু লিখিনি, যার জোরে গৌরব করা চলে অথচ এই শক্তি দন্তের অপরাধে ব্যক্তিগত বা কাব্যগত এমন কদুকাটব্য শুনতে হয়নি—যাতে সঙ্কোচের কারণ ঘটে । সাহিত্যের সেই শিথিল শাসনের দিন’ থেকে আরম্ভ করে গদ্যে পদ্যে আমার লেখা এগিয়ে চ’লেচে, অবশেষে আজি সত্তর বছরের কাছে এসে পৌছলেম । আমার দ্বারা যা করা সম্ভব সমস্ত অভাব ত্রুটি সত্ত্বেও তা ক’রেচি। তবু যতই করি না কেন আমার শক্তির একটা স্বাভাবিক সীমা আছে সে কথা বলাই বাহুল্য। কারই বা নেই। এই সীমাট দুই উপকূলের সীমা। একটা আমার নিজের প্রকৃতিগত, আর একটা আমার সময়ের প্রকৃতিগত। জেনে এবং না জেনে আমরা এক দিকে প্রকাশ করি নিজের স্বভাবকে এবং অন্যদিকে নিজের কালকে। রচনার ভিতর দিয়ে আপন হৃদয়ের যে পরিতৃপ্তি