পাতা:প্রবাসী (ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৯৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৭২ —চিরকাল এইখানে পচে মরবি ? আমরা ক’জন তাহার মনশ্চক্ষে প্রতিভাত পালাব। তুই আমাদের সঙ্গে যাবি ? —কেমন করে ? —কেমন করে পালাতে হয় জানিস্ নে ? পাচিল টপকে, আবার কেমন করে। জমাদার আসচে, এখন আর কথা হবে না, রাত্রে বলব। রাত্রে তাহারা ফিস্ ফিস্ করিয়া পলায়ন করিবার পরামর্শ করিতে লাগিল। কালীচরণকে লইয়া পাচজন । সব কথা শুনিয়া কালীচরণ বলিল,—তোরা যা, আমার পালাবার ক্ষমতা নেই। একজন অন্ধকারে কালীচরণের গল টিপিয়া ধরিল, বলিল,—সব কথা জেনে আমাদের ধরিয়ে দিবি, না ? তোকে খুন করে আমরা ফাসি যাব। গল ছাড়িয়া দিলে কালীচরণ ইপিাইয়া বলিল, —আমাকে দিয়া কোন কথা প্রকাশ হবে না, আমি যেন কোন কথা শুনিনি। আর চারজন কয়েদী দিন-কতক পরে পলায়ন করিল বটে, কিন্তু একজন তখনি প্রহরীর গুলিতে মরিল, বাকি তিনজন কিছুদিন পরে ধরা পড়িল। জেল হইতে পলায়ন করিবার অপরাধে তাহাদের আরও তিন বৎসর করিয়া কারাদণ্ড হইল, পায়ে দিনরাত বেড়ী, অপর কয়েদীদের সূঙ্গে মিশিতে পাইত না। বৎসর দুই জেলে কাটাইবার পর ৩৫১ নম্বর কয়েদী জেলরের কৃপাচক্ষে পড়িল। চোর ডাকাত বদমায়েস লইয়াই জেলে নিত্য কৰ্ম্ম, কিন্তু ৩৫১ নম্বর সে দলের নয়, ইহার সাজ হওয়া সম্বন্ধে একটা কিছু গলদ আছে। জেলর খাতা খুলিয়া মকদ্দমার সংক্ষিপ্ত নোট পড়িল । ৩৫১ নম্বরকে ডাকিয়া পাঠাইল । সে ঘরে আর কেহ ছিল না। জেলর বলিল,—কালীচরণ ! কালীচরণ থতমত খাইয়া উত্তর দিতেই ভুলিয়া গেল । এতদিম পরে আবার তাহাকে নাম ধরিয়া ডাকে ! এখানে তো কাহারও নাম নাই, যে যার নাম জেলের ফটকের বাহিরে রাখিয়া আসে। তাহাকে নাম ধরিয়া ডাকিতেই যেন জেলের প্রাচীরের ইটের গাথনি কোথায় মিলাইয়া গেল, যেন আনন্দ কোলাহলপূর্ণ মুক্ত সংসার প্রবাসী—বৈশাখ, ১৩৩৭ [ ৩০শ ভাগ, ১ম খণ্ড হইল, কারাগারের বন্ধন টুটিয়া গেল । - জেলর আবার ডাকিল,—কালীচরণ ! কালীচরণ চমকিয়া উঠিয়া বলিল,—হুজুর, আমার কম্বর মাপ হয়, কেমন অন্যমনস্ক হয়েছিলাম । জেলরের চক্ষু কোমল, মুখে অল্প হাসি। যে ভ্ৰকুটি ও গর্জনে কয়েদীদের প্রাণ শুকাইত তাহার কোন চিহ্ন নাই। জেলর বলিল,—জাল নোট ভাঙাইবার জন্য তোমার সাজ হইয়াছিল ? —ই, হুজুর। —অনেক দোকানে ভাঙাইতে ? —ইl, হুজুর । —তুমি জানিতে সেগুলা জাল নোট ? —ন, হুজুর। —আসল আর জাল নোট চিনতে পার ? —না হুজুর, আমি মুখ খু মানুষ । —নোট তুমি কোথায় পেতে ? —যে বাবুদের কাছে চাকরী করতাম তার ভাঙাতে দিত । —তারা কোথায় ? —তারা পালিয়ে গিয়েচে । জেলর খানিকক্ষণ কালীচরণের মুখের দিকে চাহিয়৷ দেখিল, তাহার পর কহিল,—আচ্ছ, এখন তুমি যাও। কালীচরণ নিজের কাজে চলিয়া গেল। সেই দিন হইতে জেলরের আদেশ-মত কালীচরণকে কোন কঠিন কাজে নিযুক্ত করা হইত না। আরও কিছুদিন পরে কালীচরণ ওয়ার্ডার হইল। কয়েদীরা সকলে দেখিল, জেলর কালীচরণকে অনুগ্রহ করে, তাহাকে কোন রকম শাসন করে না, কখনো দুৰ্ব্বাক্য বলে না, অনেক সময় নিজের আপিস ঘরে তাহাকে ডাকিয়া লইয়া গিয়া কথাবার্তা কয় । একা থাকিলেই কালীচরণ অন্যমনস্ক হইত। জেলের বাহিরে মুক্ত সংস্নার কি রকম দেখিতে তাহা কল্পনা করিবার চেষ্টা করিত। এক এক সময় পূৰ্ব্বকথা স্বপ্ন মনে হইত, এই কারাগারই যেন বাস্তব, আর সব মিথ্যা ।