পাতা:প্রবাসী (ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৯৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

১ম সংখ্যা ] দিয়া লিখাইত। জেলর কালীচরণকে পড়াইয়া শুনাইত, উত্তরও সে লিখিয়া দিত। এই সময় পত্র আসিল কালীচরণের কন্যা বসন্ত রোগে মারা পড়িয়াছে। কালীচরণ বজ্রাহতের ন্যায় বসিয়া পড়িল । জেলর তাহাকে দুই চারিট সান্তনাবাক্য বলিল। কালীচরণের চক্ষে জল পড়িল না, শূন্ত, শুষ্ক, উত্তপ্ত চক্ষে চাহিয়া রহিল। তাহার হৃদয়ের কোমল সরসত, অশ্রুর উৎস যেন দগ্ধ হইয় গেল। ধীরে ধীরে উঠিয়া চলিয়া গেল। ইহার পূৰ্ব্বেও কালীচরণ অধিক কথা কহিত না, অপর কয়েদীদের সঙ্গে বড়-একটা গল্প-গুজব করিত না, কিন্তু এই বিপদের পর সে যেন মুকের মত হইয়া গেল, তাহার মুখে কথা শুনিতেই পাওয়া যাইত না । কেহ কিছু বলিলে একটা কথার উত্তর দিত বা সেখান হইতে চলিয়া যাইত। কাজ যেটুকু করিতে হয় করিত, কিন্তু কাজে অমনোযোগী হইলে জেলর তাহাকে কিছু বলিত না | কয়েক মাস পরে একদিন জেলর তাহাকে ডাকিয়া বলিল, কালীচরণ, আমার কাছে পত্র আসিয়াছে যে তোমার মকদ্দমার সমস্ত কাগজ সরকার হইতে তলব হুইয়াছে। বোধ হয় শীঘ্রই তোমার খালাসের হুকুম হইবে। কালীচরণের মুখে আনন্দের কোন চিহ্ন নাই । কহিল,—হুজুর, আমার এখন সব জায়গায়ই সমান। । এক সপ্তাহ পরে কালীচরণের গ্রাম হইতে পত্র আসিল যে সর্পাঘাতে তাহার স্ত্রীর মৃত্যু হইয়াছে। এ ংবাদেও তাহার চক্ষে জল আসিল না । মে পাষাণ মুক্তির মত স্থির হইয়া দাড়াইয়া রহিল। আরও একমাস কাটিয়া গেল। সন্ধ্যার সময় জেলর तृनी Գ(t بریجیعی مجمع عمخته কালীচরণকে বলিল,—তোমার খালাসের হুকুম হয়েচে, কাল সকালে তুমি খালাস পাবে। የ কালীচরণ বলিল,—হুজুর, আমি কোথায় যাব ? আমার ত যাবার কোথাও জায়গা নেই। জেলর দুঃখ প্রকাশ করিল, কহিল,—তোমার যে বিপদ হয়েচে তার তো কোন উপায় নাই। বাড়ী গিয়ে ভগবানকে ডেকো । —তিনি তো এখানেও আছেন। পর দিবস প্রাতঃকালে কালীচরণের মুক্তি হইল। কাজের হিসাবে কিছু সামান্য টাকা তাহার পাওনা ছিল, সেই সঙ্গে জেলর আর পাচটি টাকা দিল । জেলের প্রকাণ্ড ফটক পার হইয়া কালীচরণ বাহিরে আসিয়া দাড়াইল। আকাশপ্রান্তে মাঠের মাঝখান দিয়া স্বর্য্যোদয় হইতেছে। সম্মুখে রাজপথ, পথের দুইধারে বড় বড় অশ্বখ ও বট গাছ, গাছে পার্থীর কোলাহল, প্রভাত-বায়ুতে বৃক্ষপত্রে মৰ্ম্মর শব্দ। দূরে ধানের ক্ষেতে ধান পাকিয়াছে, ধানের শীষ রাশি রাশি স্বর্ণশলাকার ন্যায় ক্ষেত আচ্ছন্ন করিস্কা রহিয়াছে। অন্ধকারে ঘরের দেয়াল যেমন মাথায় লাগে, প্রভাতআলোকে মুক্ত আকাশ যেন সেই রকম কালীচরণের মাথায় লাগিল। তাহার ইপি ধরিল, বৃহৎ সংসার-অরণ্যে দিশেহারা হইয়া পড়িল। সে কোথায় যাইবে ? তাহার গন্তব্য স্থান কোথায় ? কে তাহার পথ চাহিয়া আছে ? সে কাহার কাছে গিয়া দাড়াইবে ? কারাগারের চারিট প্রাচীরের গণ্ডী বরং ছিল ভাল। সংসার যে বৃহৎ কারাগার, ইহাতে পথহাবা হইয়া ঘুরিতে হয়। এ মেয়াদ কবে ফুরাইবে, এ কারাগার হইতে কবে মুক্তি হইবে ?