পাতা:প্রবাসী (দশম ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৫৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

১ম সংখ্য ] সে তোমার সঙ্গে একটা মিটমাট করতে চায়। তার মনে কষ্ট হয়—এমন কোন কথা তাকে বোলে না । এখন তার মৃত্যু আসন্ন। আবার আমাকে এই অনুরোধ কেন ?—ফ্রেডেবিক মনে মনে ভাবিতে লাগিল । মনকষ্ট অপেক্ষ ফ্রেডেরিকের 'কৌতুহল প্রবল হইয়া উঠিল। তখন ফ্রেডেরিক দ্বার খুলিয়া, রোগশয্যাশায়িনী লুসিলের শয়ন-কক্ষে প্রবেশ করিল। বালিসের ধবলতার মধ্যে লুসিলেরও রং ধপ-ধপ করিতেছে—একেবারে ফ্যাকাসে সাদা। এখনও লুসিলের শ্ৰীটুকু যায় নাই, যদিও মুখে বলি-রেখা পড়িয়াছে, পার্চমেণ্টকাগজের মত গাত্রের চৰ্ম্ম শুকাইয়া গিয়াছে। লুসিল বিছানার ঠাও। চাদরের ভাজের মধ্যে নিমজ্জিত—মনে হইতেছিল যেন একটি ক্ষুদ্র চৈমস্তিক কুসুম বরফের মধ্যে ডুবিয়া আছে। রোগ-যন্ত্রণায় তাহার চক্ষু কোটরে ঢুকিয়া গিয়াছে। লুসিল তাহার সেই কোটর-প্রবিষ্ট চোখ দুটি তুলিয়া ফ্রেডেরিকের চোথের পানে ভয়ে-ভয়ে চাহিল । এই মৌন কাতর দৃষ্টিতে ফ্রেডেরিকের মনে একটা বিষম আন্দোলন উপস্থিত হইল। এই কিছু পূৰ্ব্বে যে একগুয়েমি করিতেছিল, কত থামৃখেয়ালি ফরমাস করিতেছিল, কত আদুরেপন করিতেছিল—হঠাৎ কেন সে এরূপ দীনভাবাপন্ন ও ভীত হইয়া পড়িল ? নাeানি ইতিমধ্যে ডাক্তার ও পাদ্রির সহিত উচ্চার কি কথাবার্তা হৃষ্টয়াছে । ঘটনা ঘটিয়াছে যাহাতে লুসিলের মনে ভয় হইতে পারে । শয্যার নিকট ফ্রেডেরিক হাটু গাড়িয়া বসিয়া আছে। চোখের জল আটকাইবার জন্ত প্রাণপণে চেষ্টা করিতেছে। তবু কিসের ভাবনায় তার মন আকুল হইয়াছে তাঙ্গ সাহস করিয়া লুসিলকে বলিতে পারিতেছে না । —লুসিল, লুসিল! ন জানি ওরা তোমাকে কি বলেছে,—কেন তুমি এত বিয়া হয়েছ ? লুসিল নৈরাশুময় দৃষ্টিতে ফ্রেডেরিকের মুথের পানে সমান চাহিয়া আছে। পরে, তাহার বিবর্ণ ওষ্ঠছয় উন্মুক্ত করিয়া,–যেন দূর হইতে কে কথা কহিতেছে এইরূপ অতি ক্ষীণশ্বরে এই কথাগুলি বলিল –আমার মৃত্যু আসন্ন, ডাক্তার আমাকে জানাইয়া দিয়াছেন । এমন কি সংকলন ও সমালোচন—ক্ষম। ჭა) ফ্রেডেরিকের চক্ষু হইতে অশ্র গড়াইয়া পড়িতে লাগিল ; এবং কেহ না দেখিতে পায়, এই জন্ত হাত দিয়া মুখ ঢাকিল। তাহার পর, ফ্রেডেরিক, লুসিলের ঠাও। ছোট ছোট আঙ্গুলগুলির উপর হাত বুলাইতে লাগিল ; তখন লুসিল আবার ক্ষীণস্বরে বলিতে আরম্ভ করিল। –কিন্তু পাদ্রির কথায় আমার যতটা কষ্ট হয়েছে, ডাক্তারের কথায় তেমন হয় নি! পাদ্রি আমায় বেশ বিশ্বাস জন্মিয়ে দিয়েছেন যে আমি তোমার নিকট অপরাধী! —সে পাগল !—ফ্রেডেরিক এইকথা প্রচও স্বরে বলিয়া উঠিল; পাছে অশ্রুজল দেথিতে পায় এখন আর সে ভাবনা না করিয়া, ফ্রেডেরিক আবেগভরে দুই বাছ দিয়া লুসিলের ভঙ্গুর দেহফষ্ট জড়াইয়া ধরিল। —লুসিল! আমি তোমাকে যেমন ভালবাসি, তুমিও আমাকে তেমনি ভালবাস । তোমা কতেই আমি মুখের প্রথম আস্বাদ পেয়েছি ! এই মুমুম্বু ক্ষুদ্র রমণীর নেত্রদ্বয়, তীব্র যাতনায় আরও যেন বেশী কোটর-প্রবিষ্ট হইল, তাহার পাণ্ডুবৰ্ণ মুখের চৰ্ম্ম কুঞ্চিত হইল। কথাগুলা শেষ করিবার জন্ত যাহাতে একটু বল পায়, তাই প্রার্থনার ভঙ্গীতে যোড়হন্তে, লুসিল ভাঙ্গা ভাঙ্গ ঘর্ঘর-কণ্ঠে এই কথাগুলা বলিয়া ফেলিল – --আমার উপর তোমার ভালবাসা খুব বেশী ছিল বলেষ্ট, আমার এখন ভয়ানক অনুতাপ হচ্চে—আর যে কথা আমি তোমার কাছে স্বীকার করব সেও ভয়ামক কথা । আমায় সে পাপ স্বীকার করতেই হবে, কেন মা পাদ্রি এই করারেই আমাকে পাপ হতে মুক্তি দিয়েছেন। আমার ক্ষীণ কণ্ঠস্বরে যা বলচি–শোনো। কণ্ঠস্বর ক্ষীণ না হলেও, এর চেয়ে উচ্চস্বরে সে কথা তোমার কাছে আমি কখনই বলতে পারতেম না । শোনো তবে ফ্রেডেরিক --শোনো!—আমি তোমার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছি... ফ্রেডেরিকের হৃদয়ে যেন শত শূল বিদ্ধ হইল। যাতনায় মৰ্ম্মাস্তিক আৰ্ত্তনাদ চাপা দিবার জন্ত শয্যার আস্তরণের মধ্যে ফ্রেডেরিক মুখ গুজিয়া রহিল। লুসিলের চোখের তারা ভয়ে তমসাচ্ছন্ন হইল । ঘোর নিস্তব্ধতার মধ্যে তার প্রাণ বাহির হইবে—এই কল্পনাটি তাহাকে নিতান্ত অধীর করিয়া তুলিল ।