পাতা:প্রবাসী (দশম ভাগ, প্রথম খণ্ড).pdf/৬৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

১১২ উপর ন্যস্ত হইত। আইনীও তাহার কিছু কিছু জানা ছিল। দগুলিধি আইন, কাৰ্য্যবিধি আইন, প্রজাসত্ত্ববিষয়ক আইন, প্রভৃতির বাঙ্গল বহি গদাধরের সৰ্ব্বদা পাঠ্য ছিল। ইহাই তাহার প্রথম বার জেলও নহে। একবার বে-আইনি জনতায় মিলিত হইয়া এক প্রজার যথাসৰ্ব্বস্ব লুটিয়া লইবার অপরাধে, তাহার দেড় বৎসর কারাদণ্ড হইয়াছিল। সে আজ দশ বারো বৎসরের কথা। এবার তাহার জেল হইবার কারণ, এক এতিবেশী জমিদারের সহিত সরহদের বিবাদ উপলক্ষ্যে একটা ভয়ানক দাঙ্গ হইয়া গিয়াছিল তাহাতে অপর পক্ষের দুইটী লোক খুন হইয়া যায়। প্রকাশ, অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করিয়া, মুক্ত তরবারি হস্তে, গদাই পাল স্বয়ং সৈন্য চালনা করিয়াছিল। দায়রার বিচারে তাহার দশ বৎসর দ্বীপান্তরের আজ্ঞা হয়—আপীলে হাইকোর্টের দয়ালু জজগণ সে দণ্ড রহিত করিয়া, তৎপরিবর্তে ছয় বৎসর সশ্রম কারাবাসের আজ্ঞা দিয়াছিলেন। যথা সময়ে গদাধর দেশে ফিরিল। গ্রামে প্রবেশ করিয়া প্রথকেই শুনিল তাহার পূৰ্ব্বমনিব রমানাথ বসু ছয়মাস হইল তনুত্যাগ করিয়াছেন । তাহার পুত্র যতীন্দ্রনাথ এখন পিতার গদিতে উপবিষ্ট। নিজ বাস্তুভিটায় গিয়া গদাই দেখিল, বাড়ীঘর পড়িয়া গিয়াছে—কেবল মাত্র ভাঙ্গা ইটের স্ত,প ইটের মধ্যে হইতে বড় বড় শেওড়া গাছ ও নানা জাতীয় বন্যগুলা বাহির হইয়াছে। দুয়ার, জানালা, কড়ি, বরগা পাড়ার লোকে টানিয়া টানিয়া জালাইয়া ফেলিয়াছে। লোকের কাছে সংবাদ পাইল তাহার জেল হওয়ার বছর থানেক পরে, স্ত্রী থাইতে না পাইয়া কন্যা দুইটিকে লইয়া পিত্রালয়ে চলিয়া যায়। কিছু দিন পরে সেখানে স্ত্রীর মৃত্যু হয়। মামারা কোনও ক্রমে কন্যা দুইটিকে পাত্রস্থ করিয়া দিয়াছে—রমানাথ বাবুও কিছু অর্থ সাহায্য করিয়াছিলেন। - এই সকল দেখিয়া শুনিয়া গদাই পাল মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িল। কোথায় বাইবে, কি খাইবে, কিছুরই স্থিরতা নাই। গ্রামে তাহার একজন দূর সম্পৰ্কীয় আত্মীয় ছিল—নাম রসিকমোহন—তাহারই গৃহে আশ্রয় গ্রহণ করিল। প্রবাসী—জ্যৈষ্ঠ, ১৩১৭। | ১০ম ভাগ । দুই এক দিন পরে তাঙ্গার নিজেরও মনে হইল, লোকেও পরামর্শ দিল, পূৰ্ব্ব মনিবের পুত্রের নিকট গিয়া, আপনার অবস্থা সমস্ত জানাইলে, তিনি অবশুই একটা কিনারা করিবেন। গদাই পাল কারাবাসের পূৰ্ব্বে প্রভুপুত্রকে অল্পই দেখিয়াছিল। তাছার নাম যতীন্দ্রনাথ। তখন অধিকাংশ সময়ই তিনি কলিকাতায় থাকিয়া কলেজে পড়িতেন। তাহার প্রকৃতি কিরূপ তাহ পর্য্যবেক্ষণ করিবার স্থযোগ গদাধর কথন ও পায় নাই। তবে সাধারণ ভাবে তাহার জানা ছিল যে এ কালের শিক্ষিত যুবকগণ ঠাকুর দেবতা ও গুরু পুরোহিতের প্রতি তাদৃশ ভক্তিমান না হইলেও, লোকের সহিত আচার ব্যবহারে ধৰ্ম্মভীরু। তাই তাহার একটু ভাবন হইল যে এই নবাতন্ত্রের জমিদারের নিকট গিয়া দরবার করিলে, কোনও ফল হইবে কি না । কিন্তু পেটের জাল বড় জালা। এক দিন পথে যতীন্দ্রবাবুকে দেখিয়া গদাই ভক্তিভৱে তাহাকে প্রণাম কবিয়া, আত্ম পরিচয় দিল। যতীন্দ্রবাবু বলিলেন –“পরিচয় দিতে হবে না। আমি তোমায় চিনি। কবে বাড়ী এলে ?” “আজ্ঞে এই তিন চারি দিন এসেছি। হুজুরেব কাছে একবার যাব যাব মনে করি কিন্তু সাহস করে যেতে পারিনে।" “কোনও প্রয়োজন আছে ?” “হুজুরের কাছে একটা দরবার করবার আছে।" “ত বেশ ত—এস একদিন ।” “আছে, একটু নিরিবিলি পেলে কথাবার্তার স্ববিধে "তাই হবে। বৈকালে তিনটে চারটের সময় যে কোনও দিন আসতে পার ।” পরদিন বেল তিনটার সময়, দুর্গানাম ও অন্যান্য দেবদেবীর নাম ভক্তিভরে স্মরণ পূৰ্ব্বক, গদাই পাল যাত্র করিয়া বাহির হইল। যতীন্দ্রবাবু তখন একটি নিভৃত কক্ষে একটি ক্ষুদ্র টেবিলের সম্মুখে চেয়ারে বসিয়া, একথানি ইংরাজি গ্রন্থ, ও এসিয়াটিক সোসাইটির জর্ণাল হইতে তৰ্জ্জম করিয়া, "প্রাচীন ভারতে বন্দুক ছিল কি না”—এই সম্বন্ধে হয় । ... ২য় সংখ্যা । ] একটি গভীর গবেষণাপূর্ণ প্রত্নতত্ত্ববিষয়ক প্রবন্ধ রচনায় ব্যাপৃত ছিলেন । গদাই পালকে দেখিয়া খাতা বন্ধ করিয়া কলম উঠাইয়া রাখিলেন। মেঝেতে ফরাস বিছানা পাতা ছিল, গদাই সেখানে উপবেশন করিয়া বলিল—“সেরেস্তার কাজকৰ্ম্ম সব নিজেই দেথচেন শুনচেন-এটা বড় ভাল । স্বৰ্গীয় কৰ্ত্ত মহাশয় ও তাই করতেন। নৈলে আর বিষয়ের এত উন্নতি করে যেতে পারেন ?”—তা এখন কোন মহালের কাগজ পত্র দেখা হচ্ছিল ?” যতীন্দ্রবাবু ঈধং হাসিয়া বলিলেন—“ন। এখন জমিদারীর কাজ দেখছিলাম না—একটা রচনায় ব্যস্ত ছিলাম।” একটা হর্ষ ও বিস্ময়ের ভাব চোখে মুখে আনিয়া গদাই বলিল—“আহা বেশ বেশ। কৃষ্ণনগরের দেওয়ানজিরও অদ্ভূত ক্ষমতা ছিল। এমন সকল খামাবিষয়ক গান রচনা করতেন যে লোকে শুনে ভেউ ভেউ করে কাদত । তা হুজুর কি বিষয় রচনা করছিলেন।" খাতাখানি উন্টাইতে উণ্টাইতে যতীন্দ্রবাবু বলিলেন— "এ কোনও গান টান নয়। একটা প্রত্নতত্ত্বের প্রবন্ধ লিখছিলাম।” “কি তত্ত্ব বল্লেন ?” “প্রত্নতত্ত্ব।” “আজ্ঞা, বুঝতে পারলাম না। বুঝি ?” যতীন বাবু বলিলেন—“পুরোণে কালের অনুসন্ধান, তাকেই প্রত্নতত্ত্ব বলে। এই যেমন এটা লিখছি-‘প্রাচীন ভারতে বন্দুক ছিল কি না”—এই প্রবন্ধে আমি প্রমাণ করছি,—ছিল—এমন কি রাজা দশরথের সময়ও বন্দুক কামানের ব্যবহার জানা ছিল ।” - গদাই বলিল—“আজ্ঞে বলেন কি !—আরে, না না। রাজা দশরথের সময় বন্দুক কোথা ?—বন্দুক ত এই ইংরেজরাই এনেছে বলে বোধ হয়। তারা ধনুৰ্ব্বাণ ছড়তেন এইত পাঁচালীতেও শুনেছি-যাত্রাতেও দেখেছি।” মনে মনে একটু আমোদ পাইয়া যতীন্দ্রবাবু কহিলেন— "না, প্রাচীন ভারতে বন্দুক ছিল। রামায়ণে তার প্রমাণ রয়েছে। অযোধ্যানগরী বর্ণন করতে গিয়ে বাল্মীকি নতুন কিছু উঠেছে নবীন সন্ন্যাস । め〉も লিখছেন-সৰ্ব্বৰ্যন্ত্রায়ুধবতী শতীশত সস্থল। অর্থাৎ অন্তান্ত অস্ত্রের সঙ্গে একশোটা শতন্ত্রী ছিল। শতন্ত্রীট কামান ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না—যা একবার ছুড়লে একশো মানুষ মরে যায়।” দুই পাটি দন্ত যথাসাধ্য বিস্তার করিয়া গদাই বলিল“বাৰু মহাশয়—আপনি কিন্তু অবাক করে দিলেন। অ্যা ? এতদিন আমরা কেউ জানতাম না ? তাই ত বলি-রাবণের মত বীর--রাক্ষস হেন সৈন্ত—আমনি তীর ধনুক ছুড়ে মেরে ফেল্পে এ কখনও হয় ? কামান বন্দুক নিশ্চয়ই ছিল। এতদিন এ কথাটা কেউ জানত না । জানবে কোথেকে ? দাশুরায়ের পাচালী আর কৃত্তিবাসী রামায়ণ পর্যন্ত ত দৌড় কিনা অধিকাংশ লোকের-ছজুরের মত সংস্কৃত রামায়ণ আর কজন পড়েছে ? তা বেশ–তা বেশ । লেখা পড়ার চর্চা রাখাটা খুবই ভাল। আজ কালত বড় বড় লোকের তাই হয়েছে। যারা রীতিমত লেখাপড় শিখেছেন, তাদের কি এখন আর খসড়া খতেন জমাওয়াসিল বাকীর পাতা নিয়ে মাথা ঘামাতে ভাল লাগে ? খুব পাক৷ দক্ষ কৰ্ম্মচারী রেখে দিলেই কাজ চলে যায়। যত সব বড় বড় জমিদার, আজকাল সব কলকাতায় । কত রকম সভা করছেন, বক্তৃতা করছেন, কত জ্ঞানের কথা বলছেন। কেউ কেউ লাটসাহেবের মেম্বরের কৌমুলি পৰ্য্যন্ত হয়েছেন। লাটসাহেবের কাছে কৌম্বলির মত বক্তৃতা করছেন—দেশের কত উপকার হচ্ছে। তা হুজুরের যে রকম বিশ্বেসাধ্যি, যদি কলকাতায় গিয়ে একটু চেষ্টা করেন—তবে আপনিও কীেস্থলি হতে পারেন।” সোনার চশমার ভিতর হইতে যতীন্দ্র বাবুসকৌতুকে গদাই পালের প্রতি দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলেন। একটু নীরব থাকিয়া বলিলেন—“আমার সঙ্গে কি একটা কথা আছে বলেছিলে যে ?” • মাথাটি হেঁট করিয়া, নখের দ্বারা শতরঞ্জের উপর আঁচড় কাটিতে কাটিতে গদাই পাল বলিতে লাগিল— “আঞ্জে, কি আর বলব, আপনি ত সবই জানেন। আমি চিরকাল আপনাদের আশ্রিত, প্রতিপালিত। স্বৰ্গীয় কৰ্ত্তামশায় আমায় যৎপরোনাস্তি স্তে হ করতেন। নিজমুখে বল্পে গুমোর করা হয়—আপনি শুনেও থাকবেন-আমি