পাতা:প্রবাসী (দশম ভাগ, প্রথম খণ্ড).pdf/৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

তোমাদের দুটি ভাইয়ে কনাে বিচ্ছেদ না হয়। আমি যা সম্পত্তি রেখে যাচ্ছি, অপব্যয় না করলে, তা থেকে তোমাদের স্বচ্ছন্দে চলে যাবে। ছুটিতে মিলে মিশে এক সংসারে এক অন্নে.থাকবে। পরের কথা শুনে যেন ভাইকে পর কোরে না। লোকের কথায় কান দেবে না, স্ত্রীলোকের ঘরভাঙ্গানী । অনেক সংসারে দেখেছি, ভাইয়ে ভাইয়ে খুবই প্রণয়, কিন্তু তাদের স্ত্রীরা মধ্যে পড়ে সে প্রণয় ভেঙ্গে দিয়েছে। ভিন্ন হবে ন-বিষয় ভাগ করবে না। ভাগ করতে করতে পৰ্ব্বতও ধূলিমুষ্টি হয়ে যায়। ধৰ্ম্মপথে থাকবে-তা হলে ভগবানের রূপা তোমাদের উপর হবে। এই আমার বলবার ছিল, তা শেষ হল। এখন তোমরা আমায় মধুর হরিনাম শোনাও।” বলিয়া বৃদ্ধ চুপ করিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে মোহিতলাল বলিতে আরম্ভ করিল— হরেনাম হরেনাম হরেনামৈৰ কেবলম্। কলেী নাস্তোব নাস্ত্যেব নাস্তোব গতিরন্যথা ॥ বৃদ্ধ বলিলেন—“সংস্কৃত নয়—বাঙ্গল হরি নাম বল । সেই গানটি গাও না—হরি নাম বিনে আর কি ধন আছে সংসারে—” ” তখন প্রথমে মোহিত,-পরে গোপীকান্ত সমস্বরে গাহিতে লাগিলেন-- হরি নাম বিনে আর কি ধন আছে সংসারে ? বল মাধ্যই মধুর স্বরে। হরিনামের গুণে গহন বনে শুদ্ধ তরু মুঞ্জরে— বল মধাই মধুর স্বরে। এইরূপে হরি নাম শুনিতে শুনিতে, গভীর রাত্রিতে বৃদ্ধের প্রাণবায়ু বহির্গত হইয়া গেল। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ । চক্ষুজল।' উপরে - বর্ণিত ঘটনার পর পাচটি বৎসর অতীত হইয়া গিয়াছে। ইতি মধ্যে মোহিতলাল কলেজের পাঠ সাঙ্গ করিয়া, এম, এ, বি, এল, উপাধি লাভ করিয়াছে। দাদার অনুরোধে, ওকালুতী করিবার জন্য সদরে গিয়া বৎসরাধিক কাল অবস্থিতি করিয়াছিল—কিন্তু মস্কেলও প্রবাসী—বৈশাখ, ১৩১৭। ১০ম ভাগ । জুটে নাই এবং সে ব্যবসায় তাহার মনঃপূত না হওয়াতে গৃহে ফিরিয়া আসিয়াছে। শাস্ত্রচর্চা এবং পূজা আহিকেই তৃহার অধিকাংশ সময় কাটতেছে। ইতি মধ্যে কয়েকবার গোপীকান্ত ভ্রাতার বিবাহ দিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন, কিন্তু মোহিত সন্মত হয় নাই। তাহার কারণ, প্রথমতঃ সংসার ধৰ্ম্মে অনিচ্ছা, দ্বিতীয়ত: ভ্রাতৃবিচ্ছেদশঙ্কা। মোহিতের মনে হইত, পিতা মৃত্যুশয্যায় আদেশ দিয়া গিয়াছেন, স্ত্রীলোকের কথায় যেন ভ্রাতার সহিত প্রণয়ভঙ্গ না হয়। তাই মোহিত মনে করিত, দূর হোক, বিবাহ না করাই ভাল। এখন যেন মনে করিতেছি, ভ্রাতার বিরুদ্ধে স্ত্রী হাজার বলিলেও সে কথা কখনই গ্রাহ করিব না। কিন্তু কাৰ্য্যকালে, প্রণয়ের মোহে যৌবনের কুহকে মজিয়া, তখন আমার মতিগতি যে এই প্রকার থাকিবে, তাহারই বা নিশ্চয়তা কি ? তাহার অপেক্ষা, ও পথে না যাওয়াই ভাল । মোহিত স্বয়ং বিবাহবিমুখ, কিন্তু গ্রামের লোকে বিশেষতঃ তাহাদের বর্ষীয়সী আত্মীয়াগণ—বলিতেছে, ভাইয়ের বিবাহ দিতে গোপীকান্ত বাবুর তাদৃশ আগ্রহ নাই। বৈমাত্রেয় ভাই কি না—সহোদর হইলে কি এমনটি ঘটতে পারিত ? ছেলেটি লেখা পড়ায় যতগুলা পাস করিবার ছিল সমস্তই করিয়াছে, রূপে কাৰ্ত্তিকেয়-তুল্য—পূর্ণ যৌবনকাল উপস্থিত—আহা এমন সোণার চাদকে আউবুড় থাকিতে দেখিয়া কোন মাসী কোন পিসী, কোন খুড়ীমা, জেঠাইম, দিদিম। প্রাণ ধরিতে পারে ? আহা আজ যদি ব্রজকিশোর বুড়া বাচিয়া থাকিত—ইত্যাদি। গ্রামে কোনও সঙ্কেত-লেখক না থাকিলেও, উক্ত ভাবাত্মক বক্তৃতাগুলি যথাবিধি গোপীকান্ত বাবুর স্ত্রীর নিকট “রিপোর্টেড" হইত। সুতরাং ইদানীং তিনি স্বামীকে, দেবরের বিবাহের জন্য ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিয়াছিলেন। এবার গোপীকান্ত কলিকাতায় ভ্রাতার জন্য একটি সম্বন্ধ স্থির করিতেছেন। কন্যার পিতা মহা ধনবান ব্যক্তি। নগদ টাকা কড়ি অনেক পাওয়া যাইবে। বড় বড় এটর্ণিগণের সহিত তাহার কারবার আছে, বিবাহের পর জামাতাকে কলিকাতায় লইয়া গিয়া, হাইকোটে বাহির করিয়া, বিশেষ রকম সুবিধা করিয়া দিতে পরিবেন। ভাইটি নিষ্কৰ্ম্মার মত ১ম সংখ্যা । ] ঘরে বসিয়া থাকে, ইহা গোপীকাস্তের ইচ্ছাও নহে—এবং তাহাতে তাহার কিছু অসুবিধাও আছে। ভাইটি কলিকাতায় গিয়া ওকালতী করিলেই তিনি মুখী হন। কিন্তু কুষ্ঠাপক্ষের এক বিষম পণ। পাত্রটি রূপবান কান্তিমান হওয়া চাই । সেজন্য যত টাকা লাগে ব্যয় করিতে র্তাহারা প্রস্তুত আছেন। আজ তাহারা পাত্ৰ দেখিতে আসিবেন। পাত্র যদি পছন্দ হয়,—তখন যেমন করিয়া পারেন, গোপীকান্ত ভ্রাতাকে বিবাহ করিতে সন্মত করিবেন। আশ্বিন মাস । আকাশ ও ধরণ স্নিগ্ধ স্বৰ্য্যকিরণে পরিপ্লাবিত। অন্তঃপুরের বাগানে দাধিক তীরে একটা গাছের তলায় কুশাসন পাতিয়া বসিয়া চশমা চোখে দিয়া, মোহিতলাল একখানি যোগবশিষ্ট রামায়ণ মনঃসংযোগ পূৰ্ব্বক অধ্যয়ন করিতেছিল। পার্থে কুশাসনের উপর একটি কঁrচকড়ার নস্তের ডিবা পড়িয়া আছে—তাহার ডালার উপর সোণার অক্ষরে লেখা—হরিনাম সত্য। মোহিত যেখানে বসিয়া ছিল, তাহার অনতিদূরেই দীঘিকাজলে কত পদ্ম ফুটিয়া রহিয়াছে, হাস সাতার দিতেছে, মাঝে মাঝে মাছরাঙা পার্থী আসিয়া ছে৷ মারিয়া মাছ ধরিয়া লইয়া যাইতেছে। কিন্তু এ সকলের প্রতি মোহিতলালের দৃকপাত নাই—সে আপনার অধ্যয়নেই নিমগ্ন । পূর্ণ পরিচ্ছেদে আমরা মোহিতলালকে বালকাবয়ব দেখিয়াছিলাম,—এ পাচ বৎসরে সে পূৰ্ণবয়ঃ যুবাপুরুষ হইয়াছে। ওষ্ঠের উপরাংশ এখন সুপুষ্ট গুম্ফরাজির দ্বারা আবৃত। গৌরীকৃত চিবুকের অগ্রভাগ মানসিক দৃঢ়তার পরিচায়ক। চক্ষু দুইটি ধীর ও স্থির-দৃষ্টি যেন শাণিত শলাকার মত। ললাট চিন্তাশীলতার পরিচায়ক কুঞ্চনরেখাবলী সমাবৃত। বেলা বাড়িয়া উঠিল । সহসা মোহিতলালের কণে প্রবেশ করিল—“ছোট দাদা ।” পুস্তক হইতে মুখ উঠাইয়া মোহিতলাল পাশ্বে চাহিয়া দেখিল। একটি দ্বাদশবর্ষীয় বালক বলিতেছে—“ছোট দাদা।” -বালকের নাম বিনোদ চন্দ্র, মোহিতের পিসতুতো ভাই । - “ছোট দাদা—বাড়ী আসুন ।” - মোহিত এবটু বিরক্ত হইয়া বলিল—“কেন ?” নবীন সন্ন্যাসী । & বড়দাদা ডাকছেন।" . "একটু প্লরে যাব এখন, যা ।” বালক বলিল—“না, এখনই আসুন। বৈঠকখানায় ছুটি কে লোক এসেছেন। বড়দাদা আমাকে বল্লেন যা তোর ছোটদাদাকে চট্ট করে ডেকে নিয়ে স্মৃগ, দেরী না হয়।” এ কথা শুনিয়া মোহিতলাল কয়েক মুহূৰ্ত্ত বালকের মুখের পানে দৃষ্টি বদ্ধ করিয়া রহিল। পরে বলিল— “কেন রে ? দুজন লোক কেন এসেছে ?” বালক জানিত তাহারা কেন আসিয়াছে। কিন্তু বড়দাদা বলিতে বারণ করিয়া দিয়াছিলেন। তাই সে বলিল-“কি জানি।”—কিন্তু তাহার কণ্ঠস্বরে মিথ্যাভাষণজনিত একটা সঙ্কোচ ধ্বনিত হইয়া উঠিল। মোহিতলাল একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া বলিল—“ছি—ছি—ছি বিনোদ । মিথ্যা কথা বলে ? छि झेि झि ।” বালক চুপ করিয়া দাড়াইয়া রহিল। তাহাকে নিরুত্ত্বর দেখিয়া মোহিতলাল বলিল—“প্রথম ভাগ বর্ণপরিচয় থেকে পড়নি যে মিথ্যা বলা বড় দোষ—বড় পাপ ? পিতৃসতা পালনের জন্য রামচন্দ্র রাজার ছেলে হয়ে বনে গিয়েছিলেন, পড়নি ? প্রাচীনকালের হিন্দুরা প্রাণ দিয়েছে তবু মিথ্য বলেনি,—এ কথা শোন নি ? তুমিও সেই হিন্দু সস্তান, তা কি তুমি ভুলে গেলে ? মিছে কথা বলার ভীরুতা, কাপুরুষতা আজ তোমায় কলঙ্কিত করেছে। বড় দুঃখের বিষয় বিনোদ—বড় লজ্জার বিষয় ছিছিছি।” এই বাক্যবাণে জর্জরিত হইয়া বালক কাদিয়া ফেলিল। তাহার দুই চক্ষু দিয়া অবিরল ধারায় অশ্রু বহিতে লাগিল। মোহিতলালের তীব্র জালাময় দৃষ্টি সে সহ করিতে না পারিয়া, দুই হাতে নিজমুখ ঢাকিয়া, ফোপাইয়া ফোপাইয়৷ কাদিতে লাগিল । , মোহিতলাল বলিল—“কাদ। যে পাপ করেছ ত৷ চোখের জলে ঘুরে ফেলে আবার পবিত্র হও। পাপের কালী কেবল চোখের জলেই ধৌত হয়, অল্প কিছু দিয়ে তা পরিষ্কার করবার উপায় নেই।”—বলিয়া সে আবার যোগবশিষ্ঠ রামায়ণে নিমগ্ন হইল। বালকটি অবনত মুণে “. প্রস্থান করিল। - -