পাতা:প্রবাসী (দশম ভাগ, প্রথম খণ্ড).pdf/৮৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

১৬২ করিলেন—“আপনি তো লওনে থাকেন–কিন্তু আপনার নাম কি ?” "ফ্র্যাঙ্ক ওয়েষ্টহোভ।” “আমার নাম ইভ। স্তর অরচিবল্ড রোডস্ আমার * পিতা। আপনার বন্ধুর নামটি কি ?” “রবার্ট ভ্যান মায়রেন।” “আপনার নামটিই বেশ ! ঠিক ইংরাজির মতই আমি উচ্চারণ করতে পারি। কি বল্লেন আপনার নাম ?” ফ্র্যাঙ্ক পুনরায় তাহার নাম বলিলেন–এবং ইভ ইংরাজি সুরে সেই নামটি উচ্চারণ করিলেন । বলিতে বলিতে দু একবার আটকাইয়া গেল, এবং কেমন-কেমন শুনাইতে লাগিল। তাহাতে দুই জনেই খুব হাসিলেন। তার পর দুজনে পিছন ফিরিয়া দেখিলেন। ইভা বলিলেন—“বাবা, তুমি কি ক্লান্ত হয়ে পড়েছ ?” বৃদ্ধ তখন অত্যন্ত কষ্টের সহিত পাহাড়ের পথ ভাঙিয়া উঠিতেছিলেন। তাহার মুখ রক্তবর্ণ হইয়া উঠিয়াছিল— কোমরটা অনেক খানি বাকিয়া গিয়াছিল। বার্টি চেষ্টা করিয়া মুখে হাসিতেছিল বটে কিন্তু অন্তরে ভারি চটিয়াছিল মনে মনে বলিতেছিল—“এত কষ্ট করে এই মাটি আঁচড়ে ওঠায় কি আমোদ আছে বাপু ! প্রায় আধ ঘণ্টা এই ভাবে গেছে। আরে ছ্যা: !” অরক্ষণ পরেই সকলেই বিশ্রামের জন্য একথও প্রকাও পাথরের উপর গিয়া বসিলেন । ইভা মোহিত হইয়া গেলেন। কি চমৎকার দৃশু ! নীচে অতি দূরে অসংখ্য সৌধপূর্ণ ডুনজেম সহর দেখা যাইতেছে। তাহাকে বেড়িয়া ইস্পাতের পাতের মতো দুটি নদী বহিয়া গেছে, জলের উপর একটা ভয়ঙ্কর দৈত্যের মতো প্রকাণ্ড এক দুর্গ জাগিতেছে। চারিদিক হইতে নান রকমের নীল বর্ণের পর্বতমালা উঠিয়াছে।—খুব নিকটের পাহাড় কচি আঙুরের মতো নীল, তারপর মখমলের মতো গাঢ় চকচকে নীল, তারপর নীল পাথরের মতো, শেষে টরকোয়াইজের নীলাংশের মতো ! জল স্থল আকাশ পৰ্ব্বত সব নীল, সেই পরিব্যাপ্ত নীলিমার উপরে রৌদ্রের সোনার আভা পড়িয়াছে, তাহার মধ্যে ছায়া নাই, প্রখর ঔজ্জ্বল্যও নাই—বেশ মিঠা আলো । প্রবাসী—জ্যৈষ্ঠ, ১৩১৭। [ ১০ম ভাগ । ইভা চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিলেন—“কি চমৎকার! দেখেচো ঠিক ইটালির মতো ! আমার ধারণা ছিল নরওয়েটা ভারি বুনো রকমের, অতি ভীষণ—থালি সটাং সটাং পাহাড়ের চুড়ে উঠেছে। কিন্তু এ দেখচি কি চমৎকার! —কি সুন্দর স্নিগ্ধ নীল রংএ ভর । ইচ্ছে করছে এইখানে একটা বাড়ী বানিয়ে বাস করি—তার নাম দি ইভাকুঞ্জ। এক পাল পায়রা থাকবে। পায়রা গুলো যখন সাদা সাদা ডান মেলে নীল আকাশের গায়ে ওড়ে তখন কি মুন্দরই | দেখায়।” স্তর অরচিবল্ড বলিয়া উঠিলেন—“এখন তো বেশ। কিন্তু শীতের সময় ? তখন তো আর এ মূৰ্ত্তি থাকবেনা।" “নাই বা রইল। সে আমার বেশ লাগবে ;–কেমন সন্স করে বাতাস বইবে, কেমন নদীর উচ্ছাসের গর্জন উঠবে, কেমন পাহাড়ের গায়ে গায়ে ছাই রংএর কুয়াস গুলি উড়ে উড়ে বেড়াবে। আমি যেন চোথের সামনে সব দেখতে পাচ্ছি ! —“কিন্তু শীতে যে একেবারে জমে যাবি।” “না, না জমব কেন ? বেশ জানালার ধারে বসে বসে ডাণ্টে কিম্বা স্পেন্সর নিয়ে মজগুল হয়ে থাকবে । ডাণ্টে স্পেন্সর তোমার ভালো লাগে না ?” শেষ কথাগুলো ফ্র্যাঙ্ককে উদ্দেশ করিয়া বলা হইল। ফ্র্যাঙ্ক অবাক হইয়া ইভার এই উচ্ছাসের কথা শুনিতে ছিলেন । তাহার উপর হঠাৎ প্রশ্ন হওয়াতে তিনি চমকিয়া উঠিলেন। কারণ ডাণ্টের নাম তিনি কানে শুনিয়াছেন বটে কিন্তু কবি স্পেন্সর তাহার নিকট একেবারে অপরিচিত,– । হাৰ্বাট স্পেন্সরকে কিছু কিছু জানেন। - “ কী, রাণী উন, রেডক্রস নাইট, বিটােমাট এসব জানেন না—কি আশ্চৰ্য্য !” তাহার পিতা বলিলেন—“থাম্‌ বাপু তুই। ঐ সব ছেলেমানুষি রূপক নিয়ে তুই যে একেবারে পাগল হয়ে উঠলি |” “কিন্তু, বাব, কি চমৎকার! আমার রূপকই সব চেয়ে ভালো লাগে—অদ্য কবিতা পছন্দই হয় না।” রকমের ” “কিন্তু বাপু বড় অলঙ্কার পূর্ণ। কেমন উড়ে উড়ো ২য় সংখ্যা । ] "সেই তে ওর মজা ! ঐতেই তো ওর সৌন্দর্য্য। এডমণ্ড স্পেন্সরের ভাব কী চমৎকার-হীরের মতো যেন জল জল করচে!” বার্টির কাছে এই প্রসঙ্গ বড় পণ্ডিতি রকমের বোধ হুইতেছিল, সে তাই চুপ করিয়াছিল। একবার কেবল ডান্টের "ইন্‌ফার্ণো” সম্বন্ধে কি একটা মন্তব্য বুঝি বলিয়াছিল। সকলের বিশ্রাম করা শেষ হওয়াতে র্তাহারা আবার স্থান ত্যাগ করিয়া উঠিলেন। ফ্র্যাঙ্ক দেখিলেন ইভার উজ্জ্বল চক্ষু দুটা যেন একটু অপ্রতিভ হইয়া নত হইয়া পড়িয়াছে—তিনি যে ফ্র্যাঙ্কের কাছে নিজের বিষ্ঠা জাহির করিয়া ফেলিয়াছেন তাহার জন্য বিশেষ লজ্জিত। ইভার মনে বিন্দুমাত্র পাণ্ডিত্যাভিমান ছিল না, তিনি মোটেই সে রকমের নহেন। প্রথমটা তাহার কথার ধরণে ফ্র্যাঙ্কের মনে একটা সন্দেহ হইয়াছিল বটে কিন্তু পরে তাহার সহিত আলাপ করিয়া এবং তাহার এই অপ্রতিভ ভাব দেখিয় তাহার সে সন্দেহ একেবারে দূর হইয়া গেল। তখন তিনি মনে মনে নিজের জন্য কেমন একটা অস্বস্তি বোধ করিতে লাগিলেন—ইভার কাছে স্বীকার করিতে হইল কবি স্পেন্সরকে তিনি পড়েন নাই— ছিঃ কি লজ্জার কথা ! ইভ কি মনে করিলেন ! মুহূৰ্ত্ত মধ্যে এ সকল দুশ্চিন্তা মনে আর স্থান পাইল না। প্রাকৃতিক দৃশ্ব মনকে একেবারে অধিকার করিয়া ফেলিল। প্রকৃতির সৌন্দর্য্য সেই ক্ষণে র্তাহীদের সম্মোহিত করিয়া । যেন কিসের এক ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে সকলকে ফেলিয়া ঘুরপাক দিতে লাগিল। সকলেরই মনে এক ভাবের স্রোত বহিল, সকলেরই হৃদয়তন্ত্রী সমস্বরে বাজিয়া উঠিল, সকলেরই প্রাণ একই রাগিণী গাহিয়া উঠিল—মুহুর্তের মধ্যে সকলের হৃদয় এক হইয়া গেল ! পাহাড়ের বাকাচোরা রাস্ত চলিতে চলিতে, শুকনে পাতার উপর দিয়া ঝোপঝাপের মধ্য দিয়া যাইতে যাইতে ফ্রাঙ্কের মনে হইল তাহারা যেন কোন এক অনন্ত পথের যাত্রী হইয়াছেন—ইভা যেন তাহার কতদিনের পরিচিত, তিনিই এই যাত্রার একমাত্র সহযাত্রী ! পশ্চাতে বার্টি ও আর্চিবল্ড রহিয়াছেন, মনে হইল, তাহারা যেন অনেক দূরে—লক্ষ যোজন ব্যবধান পরে ; তাহাদিগকে চোখে দেখা

সংকলন ও সমালোচন—ভাগ্যচক্র । 〉や○ যাইতেছেন, তাহাদের স্মৃতিটুকু শুধু মনের উপর থেলিয়া বেড়াইতেছে। ইভার সহিত র্তাহার কণ্ঠ মিলিয়া গেছে, দুজনের গলা হইতে একটিমাত্র স্বর উঠিতেছে—র্তাহাদের মধ্যে কাব্য শিল্প প্রভৃতির যে আলোচনা চলিতেছে তাহা যেন দুজনের অনেক দিনের এক সঙ্গে শেখা একটি গানের মতো শুনাইতেছিল, তাহার মধ্যে বিরাম ছিল না, বিরোধ ছিল না, অসামঞ্জস্ততা ছিল না। ফ্র্যাঙ্ক তখন মন হইতে সব সঙ্কোচ সব দ্বিধা দূর করিয়া দিয়াছেন—তিনি তখন সহজভাবে ইভার সামনে স্বীকার করিয়া ফেলিলেন যে তাহার বেশি পড়া শুনা নাই—এবং যাহা পড়েন তাহ মনে রাথিতে পারেন না। এই কথা শুনিয়া ইভ র্তাহাকে একটু মৃদু ভৎসনা করিলেন। সে ভৎসনা ফ্র্যাঙ্কের হৃদয়ে কোনো আঘাত দিল না। ইভার মধুর কণ্ঠস্বর উচ্চ হইয় আকাশে উঠিতে লাগিল—নিস্তব্ধ বনপথ কম্পিত করিয়া তুলিল—তাহাতে কুলায় হইতে দুই একটা পার্থী চকিত হইয়া উড়িয়া পালাইয়া গেল! ফ্র্যাঙ্কের চিত্ত কানায় কানায় পূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে। তাহার অস্তরের মধ্যে তিনি একটা শক্তির চেতনা অনুভব করিতেছেন—মনে হইতেছে, যেন তিনি আবার নূতন জীবন আরম্ভ করিয়াছেন—অতীতের কলুষতা মুছিয়া গেছে। কাহাকে আলিঙ্গন করিয়া বুকে ধরিবার জন্য র্তাহার অস্তরে একটা দারুণ ব্যাকুলতা জাগিয়া উঠিয়াছে ! দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ । সেই দিন সন্ধ্যাবেল বেড়াইয়া আসিয়া হোটেলে বসিয়া কাফি থাইবার সময় তাহাদের মধ্যে ভবিষ্যৎ ভ্রমণ সম্বন্ধে আলোচনা চলিতেছিল। আর্চিবল্ড বলিলেন—“আমরা এবার মলডি যাবে।” ফ্র্যাঙ্ক অমনি তৎক্ষণাৎ বলিয়া উঠিলেন—“আমরাও সেইখানে যাচ্ছি।” —“বেশ তো, তবে একসঙ্গেই যাওয়া আপনাদের ছাড়তে ইচ্ছে করচে না ।” ফ্রাঙ্কেরও বৃদ্ধের সঙ্গ অত্যন্ত ভালো লাগিতেছিল। বাটিও বলিত লোকটি বেশ ;–বড় অমায়িক, বড় ভদ্র। সুবিধা পাইলেই সে তাহার কাছে তাহার আমেরিকার যাবে।