পাতা:প্রবাসী (দ্বাত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৫৭২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নদীমাতৃক বঙ্গদেশ ঐশৈলেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বঙ্গদেশের মানচিত্র দেখিলেই বুঝিতে পারা যায়, এই দেশ নদীমাতৃক। উত্তর, পূৰ্ব্ব ও পশ্চিম দিক হইতে বহু পৰ্ব্বতপ্রস্থত নদী এই দেশে প্রবেশ করিয়া তাহাদের শাখাপ্রশাখী-সহ দেশময় ছড়াইয়া আছে। উত্তর দিকে উচ্চশৃঙ্গ হিমালয়শ্রেণী এবং পূৰ্ব্ব ও পশ্চিম দিকে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্ৰ পৰ্ব্বতরাজি, দক্ষিণ দিকে অতলস্পর্শী সমুদ্ৰ—এই চতুসীমার মধ্যে প্রায় এক লক্ষ বর্গমাইল আয়তনের সমতলক্ষেত্র ভারতবর্যের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সমৃদ্ধিশালী বলিয়া খ্যাত। কৃষিজাত সম্পদেই এই দেশের এত সমৃদ্ধি এবং নদীর ভাসাজলের দ্বারা কৃষিক্ষেত্রে সেচনকাৰ্য্য আপনা হইতে নিম্পন্ন হওয়া বাংলা দেশের বিশেষত্ব। আন্দাজ এক শতাব্দী পূৰ্ব্বেও এই প্রদেশের সমস্ত নগর ও পল্লীর অদূরেই কোনও একটি স্রোতস্বতী প্রবাহিত হইত। অধুনা সে অবস্থার কিঞ্চিৎ বিপৰ্য্যয় ঘটিয়াছে। ভূতত্ত্ববিদগণের অভিমত এই যে, নদীজলের কর্দম বা পলিমাটি সঞ্চিত হইয়া বাংলা দেশের উৎপত্তি হইয়াছে। পৰ্ব্বতের শিলাখণ্ড পরস্পর ঘর্ষণে এবং তুষাররাশির পেষণে ও জলপ্রপাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া ক্রমশ: বালুক আকারে পরিণত হয় এবং পরে পর্বতগাত্রের ও ভূপৃষ্ঠের ক্লেদের সহিত মিশ্রিত হইয়া নদীস্রোতে সমুদ্রে আসিয়া নিপতিত হয়। কোনও কারণে এই নদীমুখ বা মোহানা অবরুদ্ধ হইলেই তথায় নদী দ্বিধারা হয় এবং এই দুই শাখার ও সমুদ্রের মধ্যবর্তী স্থান ব আকার ধারণ করিয়া ক্রমশঃ সমুদ্রের দিকে বদ্ধিত হইতে থাকে। এইরূপে বদ্বীপের কৃষ্টি যুগ-যুগান্তর ধরিয়া চলিয়া আসিতেছে। নদীর গতির পরিবর্তন এবং একাধিক ছোট ব-দ্বীপের সংযোগ ঘটিয়া ক্রমশ: একটি বিস্তীর্ণ ব-দ্বীপের উৎপত্তি হয়। বঙ্গদেশ কোনও অজ্ঞাত প্রাচীনকালে, ঐতিহাসিক যুগের পূৰ্ব্বে, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের উক্ত প্রকার ক্রিয়ার ফলে সমুদ্রগর্ভ হইতে ক্রমশঃ উখিত ও গঠিত হইয়াছে এবং অদ্যাবধি পরিবৰ্দ্ধিত বা পরিবর্তিত হইতেছে। রাজমহলের নিম্নদেশ হইতে গঙ্গানদীর একটি ধারা ভাগীরথী (অজয়, দামোদর প্রভৃতি উপনদী সহ ) সাগর-সঙ্গমে প্রধাবিত হইতেছে এবং বৃহত্তর ধারা পদ্ম (মহানন্দ, করতোয় প্রভৃতি উপনদীর দ্বারা পুষ্ট হইয়া) স্বমহান ব্ৰহ্মপুত্রের সহিত সংমিশ্রতি হইয়া আরও পরে মেঘনা নামে সমুদ্রে যাইয়া শেষ হইয়াছে। এই দুইটি ধারার (ও উপনদীগুলির ) দ্বারা বেষ্টিত ত্রিকোণাকৃতি ভূভাগ ‘গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ, তথা গ্রীসীয় ঐতিহাসিকের কথিত ‘গঙ্গারদেশ, বলিয়া খ্যাত। এই দেশের মধ্য দিয়া অসংখ্য শাখা-নদী প্রবাহিত হইয়া সমুদ্রে গিয়া মিশিয়াছে। নদী-জলের পলি পড়িয়া দেশের যে-অংশ সমান হইয়া চাষবাসের উপযোগী হইয়াছে তাহাই চীনদেশীয় পরিব্রাজকের কথিত বৌদ্ধযুগের সমতট’। যে অংশে নদী ও সমুদ্রের মিলনে নূতন ভূমি গড়িয়া উঠিতেছে সেই অংশে প্রকৃতি-রাজ্যের কারখানা ; এখানে মনুষ্যসমাগম নিষেধ, এজন্যই ইহা জঙ্গলাকীর্ণ ‘সুন্দরবন । বাংলা দেশের উৎপত্তির ইতিহাস যখন এইরূপ, তখন ইহার স্বভাব ও শুভাশুভ নিশ্চয়ই নদীর ভাল মন অবস্থার উপর নির্ভর করে । বস্তুত: যে-দেশে নদী নাই সে-দেশ মরুভূমি এবং যে-দেশের নদী সরিয়া বা মরিয়া গিয়াছে সে-দেশ অরণ্যে পরিণত হইয়াছে। উদাহরণস্বরূপ জঙ্গীপুর, গৌড়, সপ্তগ্রাম ও ঈশ্বরীপুর-যশোরের কথা উল্লেখযোগ্য ; এই স্থানগুলি পূৰ্ব্বেবাংলার রাজধানী বা বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল, কিন্তু কালক্রমে নদীর গতি পরিবর্তনপ্রযুক্ত ঐ সমৃদ্ধ নগরগুলি এক্ষণে জনমানবহীন হইয় পড়িয়াছে। অপর পক্ষে দেখা যায় ধে নদীপথের সাহায্য পাইয়া অনেক স্থানে নূতন শহর গড়িয়া উঠিয়াছে। কবি যদুগোপাল যথার্থই গাহিয়াছেন—