পাতা:প্রবাসী (দ্বাত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৫৭৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আশ্বিন প্রবাহিনি, তব তীরে নগরী যে সব, তোমার প্রদাদে তার খাতি লভে কত ; তুমিই মিলাও আনি পণ্য শত শত, বাণিজ্য নহিলে কিসে তাদের গৌরব ? নদীর সান্নিধ্যে যে কেবল লোকের যাতায়াত এবং পণ্যের আগম-নিগমের সুবিধা হয় তাহা নহে। পৰ্ব্বতপ্রস্তুত নদীর দ্বার সকল দেশেরই, বিশেষতঃ নদীগঠিত বাংলা দেশের, বিশেষরূপে কল্যাণ সাধিত হয়। বাংলা দেশের বিশাল সমতল বক্ষের উপর দিয়া অসংখ্য শাখাপ্রশাখা সহ বহুতর পাৰ্ব্বত্য নদী বহিয়া যাইতেছে । পাহাড়ের ঢল নামিলে নদীর জল ছুই কূল ভাসাইয়৷ পাশ্ববৰ্ত্তী নিম্ন প্রদেশে ছড়াইয় পড়ে এবং নদীগুলি পরস্পর সংযুক্ত থাকায় উচ্ছসিত জল সমগ্র দেশময় বিস্তারিত হইয়৷ ভূপৃষ্ঠের যাবতীয় বিষ ও আবর্জন ধৌত করিয়া মূল্যবান পলিমাটি’ ফেলিয়া ক্রমশঃ নদী দিয়া বহিয়া যায়। গৈরিক নদী-জল দেশের আবর্জনা বিধৌত করিয়া ঠিক যেন ইহাকে ‘আরোগ্য-স্বান করাইয়। চন্দনের প্রলেপ দিয়া যায়। বর্ষারম্ভের রক্তাভ জল পৃথিবীর ক্ষুধাতৃষ্ণার নিবৃত্তি করিয়৷ পৃথিবীকে রত্নপ্রস্থ করিয়া থাকে। বিজ্ঞানের চক্ষে, অন্যান্য জীবের ন্যায় পৃথিবীরও প্রাণ আছে ; ভূপৃষ্ঠেরও ক্ষয় বৃদ্ধি হয়। সুতরাং নীরোগ থাকিবার জন্য মতুষ্যাদি সকল জীবের যেরূপ স্নান অত্যাবশ্যক, সেইরূপ ভূপৃষ্ঠেরও নদী-জলে আপ্নত হওয়া প্রকৃতির নিয়ম। পৃথিবী আবর্জনমুক্ত ও সজীব থাকিলেই ভূতলবাসী জন-মানব নীরোগ থাকিতে পারে। আমাদের গৃহপ্রাঙ্গণ শৌচার্থে যেরূপ বিশুদ্ধ জলের আবশ্যক, সমগ্র দেশ শোধনাৰ্থেও তদনুরূপ জলের ব্যবস্থার প্রয়োজন। এই উদ্দেশ্যেই প্রকৃতির নিয়মে বাংলা দেশে অপরিমিত জলের সমাবেশ হয়। গিরিবিগলিত অম্বুরাশি যখন নদীবক্ষে বহিতে আরম্ভ করে সেই সময়েই বর্ষার বারি-ধারার সমাগম হয়। ফলতঃ নদীজল উচ্ছসিত হইয়া উপকূল প্লাবিত করিয়া দেশের উপর দিয়া মৃদু বন্যার আকারে বহিয়া যায়। যদি মনুষ্যকৃত অবরোধে বাধাপ্রাপ্ত না হয় তাহা হইলে এই বন্যা কখনও ভীষণ ভাব ধারণ করিতে পায় না। বর্ষা প্রশমিত হইলেই বস্তার অবশিষ্ট জল নদী-গহবরে প্রত্যাবর্তন করে। অল্পদিন নদীমাতৃক বঙ্গদেশ Ն(tՖ মধ্যেই স্বজলা বঙ্গভূমি দিগন্ত পৰ্য্যন্ত শস্যখামলা হইয়। ' উঠে। নদী হইতে উৎসারিত এই বন্যার জলের স্বাভাবিক গতি ও ক্রিয়া কৃত্রিম কৌশলের দ্বারা রুদ্ধ না হইলে দেশের অশেষ মঙ্গল সাধিত হয়। এই জলের কর্দম 'পলি স্বরূপে পড়িয়া ভূমিকে উর্বর করে এবং ভূমির নিম্নতা ও ক্ষয় পূরণ করে। বন্যার জলে প্রচুর পরিমাণ মৎস্য-ডিম্ব ভাসিয়া আসে এবং ঐ জল বিল ও পুষ্করিণীতে প্রবেশ করায় তথাকার পুরাতন দুষিত জল নিকাশ হইয়া যায়, যথেষ্ট মৎস্য উৎপন্ন হয়, ও ঐ মৎস্তাশাবক যাবতীয় মশকাদি কীটকে গ্রাস করে। বন্যার জলের দ্বারা মুক্তিকার নিম্নস্তর পর্য্যন্ত অধিকতর রসসঞ্চার হওয়ায় গ্রীষ্মকালে জলাভাব হয় না এবং থাল ও উপনদী জলপূর্ণ হওয়ায় নৌচালনার বিশেষ স্থবিধা হয় । বস্তার জলের আর একটি উপকারিত এই যে, ইহা জলস্থলের শৈবাল লতাগুল্মাদি সমূলে বিনাশ করে। বাংলা দেশে উচ্চ ভূমিতে বাস ও নিম্ন ভূমিতে চাষ, ইহাই চিরন্তন ব্যবস্থা। যতদিন এই ব্যবস্থার অনুসরণ হইয়াছিল এবং আমরা প্রকৃতিকে আয়ত্তাধীন করিতে চেষ্টা না করিয়া প্রকৃতির বশীভূত ছিলাম, ততদিন এই দেশ সৰ্ব্বরকমে সমৃদ্ধিসম্পন্ন ছিল । নদীসমাকীর্ণ বঙ্গের পল্পী স্বর্ণপ্রস্থ কলিয়াই এই দেশের নাম ‘সোনার বাংলা । ইহার উপকণ্ঠে প্রবাহিতা স্থবৰ্ণরেখা নদী ইহার সনাতন গৌরব স্মরণ করাইয়া দিতেছে। মোগল-সম্রাট আওরংজীব এই দেশকে ‘ভারতস্বৰ্গ’ বা ‘স্বৰ্গদেশ” আখ্যা দিয়াছিলেন, এবং দর্শনমাত্রই ‘সাত সমুদ্র তের নদী’ পারের বণিকগণের চক্ষে ইহা এত লোভনীয় হইয়াছিল। খৃষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে শুষ্ক পাশ্চাত্য দেশের সভ্যতার তাড়নায় এবং বিদেশী নাগরিকগণের গাত্রম্পর্শে আমরা বুঝিলাম বাংলা দেশের পল্পীজীবন নিতান্ত অসভ্যতার পরিচায়ক। স্বতরাং অনতিবিলম্বে আমরা পাকা বাড়ি ও পাথুরিয়া রাস্তা প্রস্তুত করিতে লাগিলাম এবং যে খাল ও নালার সাহায্যে নদীর ঘোলা জল দেশময় ছড়াইয়া পড়িত সেই পয়ঃপ্রণালীসমূহ অগ্রেই যথাসম্ভব বন্ধ করিয়া দিলাম। শীঘ্রই রেলগাড়ীর যুগ আসিয়া পড়িল ; সেজন্ত কৃষিক্ষেত্র, বিল ও জলাভূমির o: