পাতা:প্রবাসী (দ্বাত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৭৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

S99áు ব্যঙ্গ করিয়া লিখিয়াছিলেন, “মহাজন পদাবলী, রাধাকৃষ্ণ ঢলাঢলি । ললিত লবঙ্গ লতা, গোস্বামী খুড়োর মাথা ।” বৈষ্ণব কবিতার হ্যায় গীতিকবিতা যে জগতে বিরল এ কথা কেহ মনে করিত না। বটতলার নিকৃষ্ট পুস্তকালয়ে, বৈষ্ণব ভিক্ষুকের কণ্ঠে ও ভাবুক ভক্ত বৈষ্ণবের গৃহে বৈষ্ণব কাব্য আশ্রয় লাভ করিয়াছিল । বাঙালী কবিদের মধ্যে ' এক রবীন্দ্রনাথ বৈষ্ণব কবিতার গুঢ় মৰ্ম্ম সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করিয়াছিলেন। কিশোর বয়সে, তাহার প্রতিভার উন্মেষের প্রথম অবস্থাতেই তিনি বৈষ্ণব কবিতার প্রতি অতুরক্ত হইয়াছিলেন। বটতলার পুথি লইয়াই তিনি পদকল্পতরু পড়িতে আরম্ভ করেন। মধুসুদন দত্ত “মাতৃ-ভাষারূপে খনি, পূর্ণ মণিজালে” পাইয়া ইংরেজী রচনার “ভিক্ষাবুক্তি” পরিত্যাগ করিয়াছিলেন । রবীন্দ্রনাথ কাব্যের জহুরি । তিনি চিনিয়াছিলেন খনির সর্বশ্রেষ্ঠ মণি বৈষ্ণব কবিতা । বৈষ্ণব কবিতা দুইটি স্বতন্ত্র ভাষায় রচিত। এক মৈথিল, দ্বিতীয় বাংল। বিদ্যাপতির পূৰ্ব্বে মিথিলায় কেহ কখনও মৈথিল ভাষায় কিছু রচনা করেন নাই । মিথিলার পণ্ডিতেরা মৈথিল ভাষাকে অবজ্ঞা করিতেন; বাংলাদেশেও পণ্ডিতেরা “ভাষা”কে তুচ্ছ জ্ঞান করিতেন। চণ্ডীদাসের পূৰ্ব্বে বাংলা ভাষায় কোন উৎকৃষ্ট গ্রন্থ রচিত হয় নাই। বিদ্যাপতি যেমন মিথিলার আদি কবি, চণ্ডীদাসও সেইরূপ বাংলার আদি কবি । বৈষ্ণব কবিদিগের মধ্যে দুই জন মিথিলাবাসা, বিদ্যাপতি এবং গোবিন্দদাস ঝ, র্যাহাকে আমরা কবিরাজ গোবিন্দ দাস বলিয়া জানি । ইহাদের কবিতা বিশুদ্ধ মৈথিল ভাষায় রচিত। লিপিকরের অজ্ঞতায় বিকৃত হইয়াছে । ইহাদের অন্তকরণে মিশ্র ভাষায় যে-সকল পদ রচিত হইয়াছে তাঁহাই ব্রজবুলি । গীতিকবিতার সকল শ্রেষ্ঠ লক্ষণ মহাজন পদাবলীতে বিদ্যমান । ভাষায়, ভাবে, ভঙ্গীতে, শব্দের কোমলতায়, ছন্দের তরলতায়, আনন্দের উচ্ছ্বাসে, মৰ্ম্মবেদনার তীব্রতায়, হৃদয়ের আবেগে বৈষ্ণব কবিতার তুলনা নাই। রবীন্দ্রনাথের কাব্য-প্রতিভার পূর্ণবিকাশ গীতিকবিতায় । বৈষ্ণব কবিতা তিনি কিরূপ প্রগাঢ় অকুরাগের সহিত পাঠ করিয়াছিলেন তাহা তাহার বিরচিত ভানুসিংহের পদাবলী । হইতে স্পষ্টবুঝিতে পারা যায়। ঐ সকল কবিতা তাহার কিশোর বয়সের রচনা। বৈষ্ণব কাব্যযুগের পর কোন বাঙালী কবি রবীন্দ্রনাথের ন্যায় ব্রজবুলির মধুমাখা ভাষা আয়ত্ত করিতে পারেন নাই। র্তাহার শৈশব ও কিশোর বয়সের রচনায় বিহারীলাল চক্ৰবৰ্ত্তীর কিছু প্রভাব লক্ষিত হয়, কিন্তু বৈষ্ণব কবিতার প্রভাব অনেক অধিক । রবীন্দ্রনাথের কবিতার শব্দমাধুর্ঘ্য একমাত্র বৈষ্ণব কবিতার সহিত তুলনা করা যাইতে পারে। কালে তাহার প্রতিভা শতদল পদ্মের ন্যায় বিকশিত হইয়া চারিদিকে পরিমল বিকীর্ণ করে। সাধারণতঃ বৈষ্ণব কবিদিগের মধ্যে বিদ্যাপতি চণ্ডীদাস শ্রেষ্ঠ বলিয়া গণিত, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ একটি প্রবন্ধে প্রমাণ করিয়াছিলেন জ্ঞানদাসও একজন শ্রেষ্ঠ কবি । জ্ঞানদাসের বিরচিত পদের এক পংক্তি অজ্ঞাতসারে রবীন্দ্রনাথের রচিত একটি চতুৰ্দ্দশপদী কবিতায় স্থানলাভ করিয়াছে। জ্ঞানদাস লিথিয়াছেন, “প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর" । রবীন্দ্রনাথের লেখ, “প্রতি অঙ্গ কাদে তব প্রতি অঙ্গ তরে।” ইহাতে কবির যশ ক্ষুণ হয় না, বরং গৌরবান্বিত হয় । বঙ্গদর্শনের যুগে বাঙালী কবিকে ইংরেজ কবির সহিত তুলনা করা হইত বলিয়াছি। আর একটা বিশ্বাস ছিল মহাকবি হইতে হইলে মহাকাব্য লিখিতে হয়। বঙ্কিমচন্দ্র রবীন্দ্রনাথকে স্নেহ করিতেন, স্বকবি বলিয় তাহার প্রশংসা করিতেন। সমবেত সভার মধ্যে নিজের কণ্ঠ হইতে মালা খুলিয়া তরুণ রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে পরাইয়া দিয়াছিলেন । স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র রবীন্দ্রনাথকে মহাকাব্য লিখিতে পরামর্শ দিয়াছিলেন। তাহার কয়েক বৎসর পরে গীতিকবিতার অধিষ্ঠাত্রী বাণীকে সম্বোধন করিয়া রবীন্দ্রনাথ লিখিয়াছিলেন, আমি নাবক মহাকাব্য সংরচনে ছিল মনে,— ঠেক্‌ল কখনৃ তোমার কাকন— কিঙ্কিনীতে কল্পনাটি গেল ফাটি হাজার গীতে । মহাকাব্য সেই অভাব্য দুর্ঘটনায় পায়ের কাছে ছড়িয়ে আছে কণায় কণায় ।