পাতা:প্রবাসী (দ্বাত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৮৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বৈশাখ জাবার আগেরই জায়গায় ফিরিয়া আসিয়াছে। কিন্তু থরথর গতিবেগের স্পন্দন সমস্ত দেহ দিয়া অনুভব করিতে লাগিল । থাকিয়া থাকিয়া সলিল পৃষ্ট স্নিগ্ধ বাতাস গায়ে লাগিতেছে, নীচে নৌকার বাতায় প্রতিহত স্রোতোজলের একটান কলকল শব্দ, অশ্রুভারাক্রান্ত মনের চিন্তায় নিম্পূহত, সমস্ত মিলিয়৷ ঐন্দ্রিলার চেতনার উপর একটি আদ্র করুণ তন্দ্রীর যবনিক রচনা করিয়া দিল । যখন ঘুম ডাঙিল দেখিল হেমবালা একট চাদর মুড়ি দিয়া বিছানার একপাশে জড়সড় হইয়া শুইয়া আছেন। বাহুর আড়ালে মুখটা ঢাকা পড়িয়াছে, তবু ঐন্দ্রিলার বোধ হইল তিনি জাগিয়া আছেন। মাকে ডাকিয়া সন্দেহের নিরসন করিতে তাহার ইচ্ছা করিল না। ধীরে ঝাপ ঠেলিয়া বাহির হইয়া আসিল । আধখান ঝাপকে আড় করিয়৷ বসাইয়া মাল্লাদের কৌতুহল-দৃষ্টি হইতে নিজেকে সে আড়াল করিল, তারপর সম্মুখে পলকহীন দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া নিম্পদ হইয়া বসিয়া রহিল । বাতাস পড়িয়া আসিয়াছে। পালে নামানে হয় নাই, কিন্তু দাড়ের টানে দমকে দমকে নৌকা অগ্রসর হইতেছে" দাড়ের ফলার আঘাতে ভূত জলের আবৰ্ত্ত ঐন্দ্রিলার শূন্যতানিবদ্ধ অলসদৃষ্টির সম্মুখে মুহূর্তে মুহূৰ্ত্তে ছুটিয়া আসিয়া অন্তৰ্হিত হইয়া যাইতেছে। মনে মনে কখন সে একটি আবর্তের সঙ্গে আর-একটির তুলনা করিতে আরম্ভ করিয়াছিল তাহ সে জানে না । ক্রমে যেন সেই সূত্র ধরিয়াই চিন্তার আবৰ্ত্ত তাহার মনে ঘনাইয়া আসিল । যাহা অপরিহার্য্য নির্বিরোধে তাহাকে জীবনে স্বীকার করিয়া লওয়াই তাহার চিরকালের স্বভাব ছিল, আজও সে তাহাই করিয়াছে। নচেৎ যদি ইচ্ছা করিত, বিরোধ করিয়া, গোল বাধাইয়া পিতাকে শেষ একবার দেখিয়া তাহার পদধূলি লইয়া আসা তাহার পক্ষে কঠিন হইত না। কিন্তু বিরোধ করিয়া অপ্রীতিকর অবস্থাটাকে আরও অপ্রীতিকর করিয়া তুলিতে তাহার ইচ্ছা করে নাই। এই শেষ মুহূর্তের আদর্শনের বেদন কোনোদিন হয়ত সে ভুলিতে পরিবে না, কিন্তু এমন আরও কত বেদনাই ত তাহার শৃঙ্খল Գ:» হৃদয়ের গোপনে পুঞ্জীভূত হইয়া আছে, নিজ হাতে তাহাদের প্রতিকার-চেষ্ট কোনোদিন সে করে নাই। নিজেকে লইয়া বাড়াবাড়ি করিতে তাহার কিছুমাত্র ভাল লাগে না। তাছাড়া পিতাকে দেখিতে বা তাহাকে প্রণাম করিয়া আসিতে কোনও বাধা আছে এমন কথা হেমবালা একবারও তাহাকে বলেন নাই । বিরোধ কাহার সঙ্গে সে করিবে ? মায়ের ইচ্ছা মন দিয়া অনুভব করিয়া সে জানিয়াছে ; বুঝিয়ছে, বাধা আছে, অতি দুস্তর বাধাই কিছু আছে। কেন বাধা,কিসের বাধা তাহা সে জানে না । মাকে জিজ্ঞাসা করিতে কেন যেন তাহার ইচ্ছা হয় নাই । নিজের মনেও এ-রহস্যের সমাধানের চেষ্টা বেশীদূর অবধি সে করে নাই, অকারণেই তাহার অতান্ত ভয় ভয় করিয়াছে। সে কেবল ইহা বুঝিয়াছে, নরেন্দ্রনারায়ণ স্বয়ং এবিষয়ে হেমবালার নির্ধারণকেই স্বীকার করিয়া লইয়াছেন, গত দুই দিন তাহার পলাইয় বেড়ানোর আর-কিছু অর্থ হয় না। একাকী পিতামাতার সমবেত ইচ্ছার বিরুদ্ধাচরণ করিয়া সে কি করিবে ?...শেষ মুহূর্তে দৈবগতিকে পিতার সঙ্গে যে তাহার সাক্ষাৎ হইয়া যায় নাই ইহাতে তাহার খুশী হওয়া উচিত কি-না সে ভাবিতে লাগিল । সহসা সম্মুখে একটি ছবি। একটি ধূসর বালুচর ঘেরিয়৷ নদীটি বাক ঘুরিয়া গিয়াছে। স্থির নীলজলের উপর চকিত ছায়া ফেলিয়া এক ঝাক গাঙচিল উড়িতেছে। যেন রূপালী আগুনের ফুলকি। উপরে দিনের আলো ক্রমশঃ স্বর্ণময় হইয়া আসিতেছে। কেমন যেন করুণ ভারাতুর, যেন সোনার ভার বহিতে পারিতেছে না। দুরে তীরবনের ছায়ান্তরাল হইতে ঘুঘুর ডাক শোনা যাইতেছে। ঐন্দ্রিল ছবি আঁকিত, সব-কিছু ভুলিয়া এই সৌন্দর্ঘ্যের রসসমূত্রে ক্রমে তাহার মন নিশ্চিহ্ন হইয়া ডুবিয়া গেল। সন্ধ্যার পর গঞ্জের হাটে নৌকা ভিড়াইয়া আহারাদি করা হইল। পথে জেলে-নৌকা ধরিয়া মাছ আদায় হইয়াছিল, বুড়ির দেওয়া বেগুন, চালডাল সঙ্গে ছিল – দেওয়ানজীর নৌকায় রায় হইয়াছিল, ক্ষেত্তি দুজনের জন্যই খাবার জানিল। এবার স্বামীর সরে কন, ক্ষেত্তিও অনেক সাধাসাধি করিল, তৰু হেমাঙ্গাইতে