পাতা:প্রবাসী (পঞ্চত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/১৩৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

খলিফা আবদুল্লা অল-মামুন ডক্টর শ্ৰীকালিকারঞ্জন কানুনগো

মুসলমান-জগতে যে-সমস্ত শাস্ত্রজ্ঞানসম্পন্ন মনীষী জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, খলিফা হারুণ-অল-রশিদের জ্যেষ্ঠপুত্র মামুন তাহাদের অন্যতম। ইতিহাসে তিনি মুসলমান যুক্তিবাদিগণের অগ্রণী বলিয়া প্রসিদ্ধ। মামুনের চিন্তাধারার একটি বৈশিষ্ট্য ছিল যাহা আধুনিক সমাজে প্রশংসনীয় হইলেও সেকালের মুসলমান জনসাধারণ ও ইমামদের কাছে মনে হইত ধৰ্ম্মে স্বেচ্ছাচার, চিস্তার দুর্বলতা ও শাশ্বত সত্যের অবমাননা । মামুন আমাদের আকবর কিংবা দারাগুকে নহেন। কিন্তু উভয়ের দোষ-গুণ ছ-ই তাহার মধ্যে ছিল। মোটামুটি বলিতে পারা যায় ভারতবর্ষে যেমন দ্বিতীয় আকবর জন্মগ্রহণ করেন নাই, ভারতবর্ষের বাহিরে দ্বিতীয় মামুন আবিভূত হয় নাই। শাসকের আসনে বসিয়৷ ইহারা মুসলমান রাষ্ট্র ও সংস্কৃতিকে এক নূতন রূপ দিতে চাহিয়াছিলেন যাহা সনাতনপন্থী মুসলমান বিংশ শতাব্দীতেও স্বেচ্ছায় গ্রহণ করিতে পারে নাই ; তাহারা ভবভূতির মত “কালোহয়ম্ নিরবধি বিপুল চ পৃথ্বী"–এই সান লইয়াই সমাজের নিন্দ ও অপবাদকে উপেক্ষ করিয়াছিলেন। কাল যদি কোন দিন জ্ঞানের সংস্কার-বন্ধন ছিন্ন করে, আচারের মরু-বালুকারাশিকে যুগান্তকারী ভাবের ঝঞ্চায় অপসারিত করিয়া বিচার-বুদ্ধিকে মুক্ত করে, তখনই আকবর ও মামুনের প্রতি মানব-সমাজ স্ববিচার করিতে পরিবে। কাল-ধৰ্ম্ম লঙ্ঘন ন করিলে মানুষ প্রাকৃত-জনের উর্ধে স্থান পায় না ; অথচ কালধৰ্ম্মের বিরোধিতা সমাজের উপর কখনও কখনও নিন্দনীয় অত্যাচার। আকবর ও মামুন ছিলেন অপ্রতিহতপ্রভাব স্বেচ্ছাচারী সম্রাট ; সাম্য ও সত্ত্বের উপাসক হইলেও স্বভাবতঃ রজোগুণী। ধৰ্ম্মে ও রাষ্ট্রে র্তাহাদের অহিংসশীত ও যুক্তিবাদ যেখানে বাধা পাইয়াছে সেখানেই তাহার শাসকের স্বমূৰ্ত্তি ধরিয়াছেন। যাহারা স্ব স্ব রাজ্যে সৰ্ব্বধর্শ্বের প্রতিপোষক ছিলেন, পরমতসহিষ্ণুতা ধাহাজের চরিত্রকে মহনীয় করিয়াছিল, দেখা যায় তাহার। দু-জনেই তাহাদের কুলধৰ্ম্ম ইস্লাম ও তদানীন্তন মুসলমান-সমাজের প্রতি কোন কোন বিষয়ে অবিচারও করিয়াছেন । ইহাই আকবর ও মামুন চরিত্রের কলঙ্ক । খলিফা মামুনের রাজত্ব সম্বন্ধে বহু গবেষণা বিভিন্ন ভাষায় ও বিভিন্ন পুস্তকে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় আছে। মৌলানা শিবলী তুমানী অসাধারণ পাণ্ডিত্য ও অপরিসীম সহৃদয়তার সহিত মামুনের জীবন-চরিত উর্দু ‘অল-মামুন গ্রন্থে সমালোচনা করিয়াছেন। ব্রকম্যান্‌ সাহেব কৃত স্বযুতীর ‘তারিখ-উল-খোলাফা’র ইংরেজী অনুবাদে মামুনের চরিত্র ও রাজত্ব সম্বন্ধে অনেক কথা জানা যায়। মোটামুটি এই দুখানা পুস্তক অবলম্বনে এই প্রবন্ধ লিখিত । ર ১৭০ হিজরীর প্রথম রবিউল মাসের মাঝামাঝি সময় ( ৭৮৬ খ্ৰী: ) । হারুণ তখনও খলিফা হন নাই । তাহার ভাগ্যাকাশ নিরাশা ও আশঙ্কার ঘটায় সমাচ্ছন্ন। জ্যেষ্ঠভ্রাতা হাদি র্তাহার উত্তরাধিকারিত্বের দাবি উচ্ছেদ করিয়া জীবননাশের সঙ্কল্প মনে মনে পোষণ করিতেছেন। শাহজাদা হইয়া যাহার শাহী-তক্তে বসিবার দাবি নাই, তাহার বাচিয়া থাকিবীর অধিকারও নাই । তিনি সবে মাত্র যৌবনে পদার্পণ করিয়াছেন ; প্রেমোছানে তখনও কুম্বমোদগম হয় নাই । এই মাসের ১৬ তারিখ শুক্রবার রাত্রিতে চিস্তাক্লিষ্ট হারুণ বিছানায় গুইয়া আছেন ; এমন সময় উজীর-ই-আজমৃ ইয়াহ বরমকী আসিয় তাহাকে দুটি স্বথবর দিলেন—হাদি মারা গিয়াছেন ; তিনি খেলাফতের মালিক । ঘটনা এমনই অপ্রত্যাশিত যে হারুণ সহসা ইহা বিশ্বাস করিতে পারিতেছেন না। হাদি ও হারুণের মাতা ক্ষমতালোলুপ সম্রাঞ্জী খাইজুরাণের চক্রাস্তে সেই রাত্রেই হাদির বিলাস-সঙ্গিনীগণ র্তাহাকে বিছানায় শ্বাসরোধ করিয়া হত্যা করিয়াছিল।