পাতা:প্রবাসী (পঞ্চত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/১৯৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ছাত্রদের প্রতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমি যখন আশ্রমে ছাত্রদের আরো কাছাকাছি বাস করতুম, তখন তাদের কাচ বয়সের কাচা লেখার পরিচয় পাওয়া আমার পক্ষে ছিল সহজ। দুর্ভাগ্যক্রমে সে সুযোগ এখন আর আমার নেই। তোমাদের ভিতরে প্রবেশ করার শক্তি ও সময় আমার নেই। কিন্তু আজকের এই সভায় এসে তোমাদের চিন্তাধারার একটু পরিচয় পাওয়ার স্বযোগ ঘটল । তোমর যে-সব লেখা পড়লে, সেগুলো নানা বিচিত্র ধরণের রচনা। তার মধ্যে একটা জিনিষ লক্ষ্য করলেম— তোমরা গল্প, কবিতা এবং বর্ণনাচ্ছলে যা-কিছু লিখেছ তার প্রায় সবগুলোই রসসাহিত্যের পর্য্যায়ে পড়ে । তোমাদের রচনাতে একটা জিনিষের অভাব—সে চিন্তার উপাদানের। আজ পৃথিবীতে নানা সমস্ত দুৰ্ব্বার হয়ে উঠেছে, চারিদিকে প্রলয় তাওবের গর্জন—এ অবস্থায় মন নিশ্চিন্ত থাকতে পারে না। মানুষের ভাগ্য যখন ঘটনাসংঘাতে প্রবলভাবে নাড়া খেয়ে ওঠে তখন ভাবী পরিণামচিম্ভায় মন স্বভাবতই উৎকণ্ঠিত হয়ে ওঠে। কিন্তু সাধারণত এসম্বন্ধে আমাদের ঔৎস্থক্যের অভাব দেখতে পাই। মনে হয় তার একটা কারণ আমরা অদৃষ্টবাদী—সংসারের অনেকখানি দায়িত্ব দৈবের হাতে সমর্পণ করে নিশ্চেষ্ট থাকা আমাদের গ্রীষ্মপ্রধান দেশের অভ্যাস। চারদিকে দৃষ্টিকে সজাগ রেখে কান পেতে থাকার উদ্যম আমাদের ক্ষীণ। কিন্তু মানব-ইতিহাসের ঢেউয়ের ধাক্কা থেকে উদাসীনভাবে নিজেকে সরিয়ে রাখা আজ আর শোভা পায় না। একটা প্রচণ্ড আলোড়ন উঠেছে সমস্ত পৃথিবীব্যাপী জনসমুদ্রে, যেন সমস্ত সভ্যজগৎকে এক কল্প থেকে আর এক কল্পে উৎক্ষিপ্ত করবার মন্থন ব্যাপার স্বঙ্ক হয়েছে। আমরা আছি কালের রুজলীলাক্ষেত্রের নেপথ্যকোণে । বর্তমান মানবসমাজের বড়ো আন্দোলনে যোগ দেবার সম্যক উপলক্ষ্য আমাদের আসে নি, তার বজাগর্জন দূর ব্যবধানের মধ্য দিয়ে অপেক্ষাকৃত ক্ষীণভাবে পৌছয় আমাদের কানে। কিন্তু আমরাও তো স্বখে নেই। ঐতিহাসিক চক্রবাত্যার লেজের ধাক্কা বাইরের থেকে আমাদের বাসায় এসে লাগে, আবার ভিতরের থেকেও দুৰ্গতি বিচিত্র আকারে দিনে দিনে উঠছে দুঃসহ হয়ে। দেখতে পাচ্চি আমাদের বর্তমানের মানদিগন্তে ভবিষ্যৎ রান্ত্রির অন্ধকার আসছে ঘনিয়ে । সমস্তার পর দুর্জয় সমস্তা এসে অভিভূত করেছে দেশকে, কিসে তার সমাধান, আমরা জানি না। সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে আজ যে পরম্পর বিচ্ছেন ও বিদ্রোহ উত্তাল হয়ে উঠেছে, যদি দেখতেম, এর সহজ নিষ্কৃতি আছে তবে চুপ করেই থাকতেম। কিন্তু তার মূল প্রবেশ করেছে গভীরে, সহজে এর সমাধান হবে না । আর যদি সমাধান না করতে পারি, তবে আসবে “মহতী বিনষ্ট” । এখন চুপ করে থাকবার সময় নয়। আমাদের ভাবতে হবে, বড়ো করে ভাবতে হবে— ভাবাবিষ্ট আর্দ্রচিত্তে নয়, বুদ্ধিপূর্বক চিন্তা করে। দেশের সম্বন্ধে, সমস্ত মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আমাদের ভাবতে হবে। ভাববার কারণ হয়েছে। সেই ভাবনার অভাব দেখলাম তোমাদের রচনায় । আমরা ভাঙনধরা নদীর কুলে বসে আছি, এক মুহুর্তেই ত একেবারে ভেঙে ধ্বসে পড়তে পারে। এই যে চারদিকে গ্রামগুলো আমাদের বেষ্টন করে আছে, সেখানে প্রবেশ করলে তোমরা দেখতে পাবে, মরণদশী ধরেছে তাদের । দুঃখদারিদ্র্যের সহচর ম্যালেরিয়া যক্ষ্মা সমস্ত জাতির জীবনীশক্তিকে আক্রমণ করে চারদিকে বিস্তার লাভ করেছে । এর প্রতিকার কোথায়, সে কথা ভাবতে হবে আমাদের— নিৰ্ব্বোধের মতো নয়, ভাববিহ্বল ভাবে নয়। অধ্যয়ন, পৰ্যবেক্ষণ ও পৰ্য্যালোচনা করে সমস্তাগুলোকে যথোপযুক্ত আয়ত্ত করতে হবে। মৃত্যুদূতের দ্বারা আক্রান্ত দেশের বিপন্নতার বেদনা কেন পৌছবে না তোমাদের চিন্তায়, কৰ্ম্মে ? তোমরা স্কুলবিভাগের ছাত্ৰ হ’লে তোমাদের এ সব কথা