পাতা:প্রবাসী (পঞ্চত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৩৪৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ভাষা-শিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গত অগ্রহায়ণের প্রবাসীতে ( ১৩৪২ ) ভাষাশিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতামূলক একটি প্রবন্ধ পড়ে মনে হ’ল নিম্নলিখিত পত্ৰ দুখানি সময়োপযোগী। তাই প্রবাসীতে পাঠানো গেল । এম, এ, আজানকে লিখিত । সবিনয় নিবেদন, সৰ্ব্বপ্রথমে ব'লে রাখি আমার স্বভাবে এবং ব্যবহারে হিন্দু-মুসলমানের দ্বন্দ্ব নেই। দুই পক্ষেরই অত্যাচারে আমি সমান লজ্জিত ও ক্ষুব্ধ হই এবং সে রকম উপদ্রবকে সমস্ত দেশেরই আগৌরব ব’লে মনে করে থাকি । ভাষামাত্রেরই একটা মজ্জাগত স্বভাব আছে, তাকে না মানলে চলে না । স্কটল্যাণ্ডের ও ওয়েলসের লোকে সাধারণত আপন স্বজন-পরিজনের মধ্যে সৰ্ব্বদাই যে-সব শব্দ ব্যবহার ক'রে থাকে তাকে তারা ইংরেজী ভাষার মধ্যে চালাবার চেষ্টামায় করে না। তারা এই সহজ কথাটি মেনে নিয়েছে, যে, যদি তার নিজেদের অভ্যস্ত প্রাদেশিকতা ইংরেজী ভাষায় ৪ সাহিত্যে চালাতে চায় তা হ’লে ভাষাকে বিরত ও সাহিত্যকে উচ্ছৃঙ্খল ক'রে তুলবে। কখনো কখনো কোনো স্কচ, লেখক স্কচ, ভাষায় কবিতা প্রভৃতি লিখেছেন কিন্তু সেটাকে স্পষ্টতঃ স্কচ, ভাষারই নমুনা স্বরূপে স্বীকার করেছেন। অথচ স্কচ, ও ওয়েল্স ইংরেজের সঙ্গে এক নেশনের অন্তর্গত। আয়রল্যাণ্ডে আইরিশে ব্রিটিশে ব্ল্যাক্ এণ্ড ট্যান নামক বীভৎস খুনোখুনি ব্যাপার চলেছিল কিন্তু সেই হিংস্রতার উত্তেজন ইংরেজী ভাষার মধ্যে প্রবেশ করে নি। সেদিনও আইরিশ কবি ও লেখকেরা যে ইংরেজী ব্যবহার করেছেন সে অবিমিশ্র ইংরেজীই । ইংরেজীতে সহজেই বিস্তর ভারতীয় ভাষার শব্দ চলে গেছে । একটা দৃষ্টান্ত Jungle—সেই অজুহাতে বলা চলে না, তবে কেন অরণ্য শব্দ চালাব না ! ভাষা খামখেয়ালি, তার শব্দ-নিৰ্ব্বাচন নিয়ে কথা-কাটাকাটি করা বৃথা । ংলা ভাষায় সহজেই হাজার হাজার পারসী আরবী শব চলে গেছে । তার মধ্যে আড়াআড়ি বা কৃত্রিম জেদের কোনো লক্ষণ নেই। কিন্তু যে সব পারসী আরবী শব্দ সাধারণ্যে অপ্রচলিত অথবা হয়তে কোনো এক শ্রেণীর মধ্যেই বদ্ধ, তাকে বাংলা ভাষার মধ্যে প্রক্ষেপ করাকে জবরদস্তি বলতেই হবে। হত্য অর্থে খুন ব্যবহার করলে সেটা বেখাপ হয় না, বাংলায় সৰ্ব্বজনের ভাষায় সেটা বেমালুম চলে গেছে । কিন্তু রক্ত অর্থে খুন চলে নি, তা নিয়ে তর্ক করা নিস্ফল । উর্দু ভাষায় পার্স ও আরবী শব্দের সঙ্গে হিন্দী ও ংস্কৃত শব্দের মিশল চলেছে—কিন্তু স্বভাবতই তার একট। সীমা আছে। ঘোরতর পণ্ডিতও উর্দু লেখার কালে উর্দুই লেখেন, তার মধ্যে যদি তিনি ‘অপ্রতিহত প্রভাবে শব্দ চালাতে চান তা হ’লে সেটা হাস্যকর বা শোকাবহ হবেষ্ট । আমাদের গণশ্রেণীর মধ্যে যুরেশীয়েরাও গণ্য । তাদের মধ্যে বাংলা লেখায় যদি কেউ প্রবৃত্ত হন এবং বাবা মা শব্দের বদলে পাপ মামা ব্যবহার করতে চান এবং তর্ক করেন ঘরে আমরা ঐ কথাই ব্যবহার ক’রে থাকি তবে সে তর্ককে কি যুক্তিসঙ্গত বলব ? অথচ র্তাদেরকেও অর্থাৎ বাঙালী য়ুরেশীয়কে আমরা দূরে রাখা অন্যায় বোধ করি। খুশী হব তারা বাংলা ব্যবহার করলে কিন্তু সেট যদি যুরেশীয় বাংলা হয়ে ওঠে তা হ’লে ধিক্কার দেব নিজের ভাগ্যকে । আমাদের ঝগড় আজ যদি ভাষার মধ্যে প্রবেশ করে সাহিত্যে উচ্ছৃঙ্খলতার কারণ হয়ে ওঠে তবে এর অভিসম্পাত আমাদের সভ্যতার মূলে আঘাত করবে। ইতি ১১ চৈত্র ১৩৪• । ভবদীয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর