পাতা:প্রবাসী (পঞ্চত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৬৯১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

‘এক আনার ইতিহাস স্ত্রীরামপদ মুখোপাধ্যায় ছেলেটির নাম মণীশ । বয়স দশ। বয়স কম হইলেও মহণ ললাট ও উজ্জল চক্ষু দেখিলেই বোধ হয়, ছেলেটি চটপটে ও বুদ্ধিমান। বাবা উকিল ; পসার বা প্রসার খুব বেশী ন হইলেও পাড়ায় কিছু নাম আছে। প্রায়ই স্বামী-স্ত্রীতে মোটর গাড়ী কিনিবার পরামর্শ চলিতে থাকে, মণীশ কান খাড়া করিয়া সে-সব কথা শোনে। মাঝে মাঝে—বুইকু ভাল, না শেভোলে ভাল—এ-সম্বন্ধে তার মতামতও বাপমাকে জানায়। শহরের ছেলে, গাড়ী সম্বন্ধে তার অভিজ্ঞতার একটা মূল্য আছে বইকি ! সম্প্রতি মণীশের দাদামহাশয় এ-বাড়িতে অতিথি হইয়াছেন। দাদামহাশয় হইলেও লোকটির পাক চুল বা নড়া দাত কিংবা মাথায় টাক—এ-সব পদোচিত মহিমা আজও স্বপ্রকট হইয়া উঠে নাই। বয়সটাও পয়তাল্লিশের কাছাকাছি—মণীশ তার প্রথম দৌহিত্র । সে যাহা হউক, এক দিক দিয়া দাদামহাশয় তার নামের মাহাত্ম্য বজায় রাখিয়াছেন। গল্প বলিতে তিনি বিশেষ পটু, শিশুচিত্তের উপর তাই তার অধিকার অপ্রতিহত । লোকটি থাকেন পাড়াগায়ে । সেখানকার বন-জঙ্গল, বাঘ শেয়াল, নদী নৌকা ও মাছ কুমীরের গল্প শহরে ছেলে, মণীশের খুবই ভাল লাগে। এই শহরে কেবল মানুষ, কেবল ট্রাম, বাস, মোটর, রিকৃশ, ধোয়া আর কুয়াশা! এখানকার ঘাট বাধা ও জাহাজ-নৌকাভরা গঙ্গা নিতান্তই যেন ঘরের নদী। বড় চৌবাচ্চার জমা জলের যা অবস্থা গঙ্গারও তাই । ঘরের বাহুল্য ও আলোর ঔজলু এত বেশী যে, নীল আকাশ চোখেই পড়ে না। বনের কথা যা বইয়ে আছে, শার বাঘ শিয়ালের দেখা মেলে চিড়িয়াখানায় । মণীশের দাদামহাশয়ের অবস্থা ভাল। চাকরি করিতেন কোন এক সওদাগরী আপিসে—মাহিনী ছিল মোটা । ব্যান্ধের খাতাখানায় কেহ কেহ বলেন—ছয়টি-সংখ্যক অঙ্কের হিসাব চলিতেছে। দাদামহাশয় দুঃখ করিয়া বলেন, আরও কিছু দিন চাকরি করিতে পারিলে হয়ত লোকের মুখে ফুলচন্দন পড়িতে পারিত, কিন্তু কেরাণী-ছাটাইয়ের কাচি উপর ঘেষিয়া যাওয়াতে সে আশা তাহার পূর্ণ হয় নাই। কম মাহিনায় আর কোথাও চাকরি না করিয়া দেশে গিয়া ব্যবসা ফাদিয়াছেন। আশা আছে, বাণিজ্যের দ্বারাই লক্ষ্মীকে বাধিয়া যষ্ঠ সংখ্যাকে অচিরাং পূর্ণ করিবেন। নাতির পীড়াপীড়িতে দাদামহাশয় গল্প বলিতে স্বরু করিয়াছেন। কলিকাতার ছেলে—মনভুলানো পরীকথা বা ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর গল্প শুনিতে চাহে না । রাক্ষস-খোঙ্কসের অধিকার ছিল পাচ-ছয় বছর বয়সে—এখন ওই সব বাতিল হইয়া গিয়াছে। এদিকে পাড়াগায়ের গল্পও এত পুরাতন হইয়াছে যে, একবার আরম্ভ করিলে নাতি মুখস্থ পড়ার মত বাকিটা গড় গড় করিয়া বলিয়া দাদামহাশয়কে অপ্রতিভ করিয়া দেয়। দাদা মহাশয় রাগের ভান করিয়া বলেন,—তবে আমার গল্প নেই,—যা । মণীশ মিনতি করে,—না দাদু, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, আর একটা নতুন গল্প—খুব নতুন—বল। দাদামহাশয় হাসেন,—নতুন আর তোর জালায় রইল কই ? সবই ত বাসি—পুরনো। মণীশের মিনতি চলিতে থাকে,-ও শেয়াল-মারার গল্প অনেক বার শুনেছি যে ! খেজুর-রস পাড়, মটরশুঁটি খাওয়া, বাঘতাড়ানো, পার্থীর বাচ্চ ধরা যার কাছেই বলতে যাই হেসে ওঠে সব বলে, নতুন কিছু বল ।---আচ্ছা জাস্থ, তোমাদের সেই যে খালটার কথা বলতে—যেটায় কুমীর আছে—পদ্মফুল ফোটে—ছিপ নিয়ে যেখানে বড়শিতে কেঁচো গেঁথে পুটি মাছ ধরতে—ঘাটের ধারে ধোপারা যেখানে হিস' হিস’ শব্দ করে কাপড় কাচে– সেই খালের গল্পই বল না । দাদামহাশয় হাসিলেন,—তাও ত তোর মুখস্থ রে, মণে ।