পাতা:প্রবাসী (পঞ্চত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৬৯৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

করিয়া এই জিনিষের কত নিন্দাই না করিয়াছেন ; কত । বইয়ে গল্প আছে চোরের কত রকমের সাজা হয়। এই যে আনিটা হাতে লইয়া বুক তাহার টিপ, টিপ করিতেছে— এ কেন হয় ? কাজটা ভাল হইলে মনটা খুলীতে লাফাইতে থাকিত। যেমন ক্লাস-প্রমোশন পাইলে কেবলই লাফাইতে ও চেচাইতে ইচ্ছা হয়। ক্যারম খেলায় পয়েণ্ট পাইলে দুনিয়ার আর সব তুচ্ছ হইয়া যায়। রথে, দোলে বা সরস্বতী-পূজায় বাবা যখন একটা করিয়া টাকা পাৰ্ব্বণী দেন তখনকার আনন্দের তুলনা আছে কি ? বুকের মধ্যে তখনও লাফাইতে থাকে, কিন্তু এমন টিপ চিপ ত করে না । সে-আনন্দের ভাগ সকলকে ডাকিয়া চাথিয়া দেখাইতে ইচ্ছা হয়—আর এই পাওয়ার আনন্দকে—পড়ার সময় ঘুড়ি উড়াইবার মত—অত্যন্ত ভয়ে ও ভাবনায় লুকাইয়া রাখিতে প্রাণ বাহির হইতেছে ! কাজ নাই, আনিটা যেখানে পড়িয়াছিল সেইখানে রাথিয়া আসা যাক । ” মণীশ কয়েক পা আগাইয়া গিয়া আবার দাড়াইল । ভাবিল, ওটা যে চুরি—এ ভাবনাই বা আমার আসে কেন? বাবার পকেট হইতে পয়সা উঠাইয়া লওয়ার মত কিংবা স্কুলে রবির পকেট হইতে বনমালী সে-দিন যেমন পেন্সিল উঠাইয়া মাষ্টারের বেত খাইয়াছিল তাহারই সঙ্গে এই কাজটা সমান হইল কিসে? একটা ত অনি–টাকা নয়, গহনা নয়—বই, পেন্সিল—এমন কি সামান্য একটা ক্লিপও নয় যে আত্মসাৎ করার কাজ হইতে পারে । ছোট্ট একটা আনি—সে ফেলিয়া দিলে আর এক জন কুড়াইয়া লইবে । সে-ও কি মণীশের মত মিথ্য ভয়ে আনিটা ওইখানে ফেলিয়া যাইবে ? নিশ্চয়ই না। সে এটা পকেটে ফেলিয়া যে হারাইয়াছে তাহারই অসাবধানত ও নিৰ্ব্বদ্ধিতাকে মনে মনে উপভোগ করিয়া আর পাচ জনের কাছে দিব্য গল্প করিবে—হাসিবে। বাবা ত প্রায়ই বলেন, কথার মালা গাঁথিয় যে-উকিল মক্কেলের মন ভুলাইতে নপারে তার ওকালতি পাস করাই বিড়ম্বন । জগৎ বুদ্ধিমানের-বোকারা পদে পদে হয় লাঞ্ছিত আর প্রতারিত। চরি অবগু খারাপ জিনিষ—বোকামীটাও তার চেয়ে কম খারাপ কিসে ? মণীশ মনকে বুঝাইল—চুরি যখন সে করে নাই তখন এক আনা’র ইতিহাস r* 4.--B_z বোকামীও করিবে না। বরং এই স্কুড়াইয়া-পাওয়া আনিটর" Uరి স্বারা একটা সংকাজ সে করিবে। যে-কোন ভিক্ষুককে এটা দিলে তার অভাব মিটিবে—লোকটা দু-হাত তুলিয়া আশীৰ্ব্বাদ করিবে আর মণীশেরও কম পুণ্য হইবে না। মুঠার মধ্যে আনিটা লইয়া সে আরও কয়েক পা আগাইয়া আসিল—কিন্তু মুঠ খুলিয়া দেখিতে তার সাহস হইল না। আনিটা নূতন না পুরাতন ? সপ্তম এডওয়াডের মুখ না মাননীয় পঞ্চম জর্জের প্রতিকৃতি ? কোন সালের ? মুঠার মধ্যে আঙল বুলাইয়া যেটুকু বুঝা যায়—আনিট নূতনই। আনির গায়ে ছাপা লেখাগুলা আঙলে স্পষ্ট ঠেকিতেছে, এতটুকু মন্থণ নহে, ধারটা পলকাটা। চকুচকে স্বতরাং নৃতন আনি হয়ত এই সালেরই। কিন্তু নূতন বলিয়াই ত খুলিয়া দেখিতে ভয় হয়। পাশে দাড়াইয়া কেহ যদি দেখিয়া ফেলে এবং বলিয়া উঠে,—‘এই খোকা—এটা যে আমারই আনি—তুই পেলি কোথেকে ? যদি কান ধরিয়া এই এত লোকের সামনে লোকটা চড় মারে ? যদি••• —“চাই চীনাবাদাম-গরমাগরম—’ চট্‌ করিয়া মণীশের মাথায় একটা বুদ্ধি খেলিল। সে নীচু গলায় ডাকিল,—এই বাদাম—চীনেবাদাম—- সে-ডাক মণীশের কানেষ্ট ক্ষীণ ভাবে বাজিল, অন্ত লোকে শুনিতে পাইবার কথা নহে। কিন্তু ভগবান বাদামবিক্রেতাদের কান আলাদা করিয়া তৈয়ারী করিয়াছেন হয়ত! বুকের মধ্যে ধুকধুক্‌ শব্দটি খাবার ইচ্ছায় যখন অল্প একটু বাড়িয়া ওঠে তখন খাবারওয়ালার অন্তর্ষামীর মত সে-কথা কেমন বুঝিতে পারে! বালক মণীশ হয়ত জানে না, এই অন্তর্যামী খাবারওয়ালারা শিশুদের চোখের মধ্য দিয়া মনের ভাষা পড়িতে পারে অত্যন্ত অনায়াসে । —ক পয়সার বাদাম চাই, বাৰু? বাবু ডাকটি মণীশের বেশ মিষ্ট লাগিল। আজও পৰ্য্যন্ত শুধু ‘বাবু বলিয়া অনাত্মীয় কেহ ডাকে নাই। সে যে ছোট, সে যে খোকা—এই ধারণা বড়দের মনে বদ্ধমূল। শুধু এই লোকটাই তাহাকে বয়স্ক লোকের মর্যাদা দিয়া ‘বাবুর পুৰ্ব্বে খোকা জুড়িয়া দেয় নাই। মণীশকেও এই পদের মধ্যাদা রাখিতে হইবে । এক পয়সার বাদাম চাহিয়া লোকটার কাছে খাটে হইতে তাহার মোটেই ইচ্ছা নাই।