পাতা:প্রবাসী (পঞ্চত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৭৩১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আজ পিতৃদেবের মৃত্যুর সন্ধিৎসরিক দিন। আমি যখন জন্মেছি তখন থেকে তিনি হিমালয়ে ও দূরে দূরে ভ্রমণ করেছেন। দু-তিন বছর পর পর তিনি যখন বাড়ি আসতেন, তখন সমস্ত পরিবারে একটা পরিবর্তন অনুভব করতুম—সেটা আমার অল্প বয়সকে ভয়েতে সন্ত্রমে অভিভূত করতো। সেই আমার বালকবয়সে তার সত্তার যে মূৰ্ত্তি আমার কাছে প্রকাশিত হয়েছিল সে হচ্ছে র্তার একক ও বিরাট নিঃসঙ্গতার রূপ। তার এই ভাবটি আমায় খুব স্তম্ভিত করতো— এ আমার স্মরণে আছে। কেমন যেন মনে হ’ত যে নিকটে থাকলেও তিনি যেন দূরে দূরে রয়েছেন। কাঞ্চনজঙ্ঘা যেমন সন্নিকটবর্তী গিরিশৃঙ্গসমূহ থেকে পৃথক হয়ে তার উত্তঙ্গ তুষারকাস্তি নিয়ে দাড়িয়ে থাকে—আমার কাছে ঠিক তেমনি ভাবে আমার পিতৃদেবের আবির্ভাব হয়েছিল। সমবেত আত্মীয়-স্বজন পরিবারবর্গ থেকে তিনি অতি সহজে পৃথক, সমুচ্চ, শুভ্র ও নিষ্কলঙ্করূপে প্রতিভাত হ’তেন। তখন আমি ছোট ছিলুম ; ছোট ছেলেকে লোকে যেমন কাছে ডেকে ছোট প্রশ্ন স্বধোয়, সেই রকম ভাবে তিনি তখন আমায় ডেকে দু-এক কথা জিজ্ঞেস করতেন। আমার অগ্রজের কেবলমাত্র নিজেদের জীবনসম্বন্ধে নয়, সংসারের নানাবিধ খুঁটিনাটি কাজসম্পর্কেও, তার সান্নিধ্য লাভ করেছেন ও তাঁর কাছ থেকে নানাবিধ নির্দেশ পেয়েছেন,—সে স্বযোগ প্রথম বয়সে আমার ঘটে নি। তৰু পিতৃদেবকে দেখে আমার ক্রমাগত উপনিষদের একটি কথা মনে হয়েছে, "বৃক্ষ ইব স্তন্ধে দিবি তিষ্ঠত্যেকঃ” যিনি এক, তিনি এই আকাশে বৃক্ষের মত স্তন্ধ হয়ে আছেন । এখন মনে হয় তার সেই নিঃসঙ্গতার অর্থ যেন কিছু কিছু েৈত পারি। এখন বুঝতে পারি যে তিনি বিরাট নিরাসক্ততা নিয়েই জয়েছিলেন। তার পিতার বিপুল ঐশ্বৰ্য্যসম্ভার ছিল, বাহিরের দিক দিয়ে সেই ঐশ্বর্ষ্যের কত রকম প্রকাশ হ’ত তার ইয়ত্ত নেই। আহারে, বিহারে, বিলাসে, ব্যসনে কত ধুম, কত জনসমাগম। পিতৃদেব সেই ভিড়ের মধ্যে থেকেও ভিড় থেকে দূরে থাকতেন। আপনার ব্যক্তিত্বের মৰ্য্যাদা নিয়ে আপনাতে নিবিষ্ট থাকা— এই ছিল তার স্বভাব। অথচ কৰ্ম্মেও তাকে লিপ্ত থাকতে হয়েছে। আমার পিতামহের অধিকাংশ অর্থ যে ব্যাঙ্কে খাটত, সেইখানে তারই নির্দেশক্রমে সামান্ত পারিশ্রমিকে আমার পিতাকে কাজ করতে হত। যাতে তিনি বিষয়কৰ্ম্মে নিপুণ হয়ে ওঠেন তার জন্তে পিতামহ যথেষ্ট আগ্রহ প্রকাশ করতেন। যদিও দায়িত্বজনক অনেক কাজ তিনি স্বচারুরূপে নিৰ্ব্বাহ করতেন, তৰু সমস্ত বিষয়কর্মের উপর তার ঔদাসীন্য ও অনাসক্তি দেখে পিতামহ ক্ষুণ্ণ হতেন। তখন তার যৌবনকাল, বাইরের আড়ম্বর ও চাকচিক্যে মুগ্ধ হয়ে পড়, হয়তো তার মত অবস্থায় বিশেষ আশ্চৰ্য্যকর হ’ত না ; কিন্তু সমস্ত কৰ্ম্মের মধ্যে জড়িত থেকেও তিনি সকল কর্মের উদ্ধে ছিলেন। সামাজিক দিক দিয়েও আবিষ্ট হয়ে পড়ার মত অমুকুল অবস্থা তখন র্তার প্রবল ছিল ; অনেক পদস্থ ও সম্রাস্ত অভিজাত সম্প্রদায়ের লোক তখন পিতামহের কাছে বিষয় বা অন্তবিধ ব্যাপার নিয়ে নিত্য উপস্থিত হতেন । উপরন্তু দর্পনারায়ণ ঠাকুরের বাড়ির এবং পাথুরেঘাটার রাজবাটীর আত্মীয়সমবায় নিয়ে, সেই বহারপরিব্যাপ্ত সম্পর্কিত মণ্ডলীর সঙ্গে তাকে সংস্পর্শে আসতে হত। আমি ঠিক জানি নে অবগু, তবে নিশ্চিত অনুভব করিতে পারি যে, এই আর্থিক প্রতিপত্তি ও সামাজিক সমারোহের মধ্যেও তিনি সেই উপনিষদবর্ণিত একক পুরুষের মত বৃক্ষের স্তন্ধ নিঃসঙ্গত রক্ষা ক'রে চলতেন। দ্বারিকানাথ ঠাকুরের তৎকালীন বিপুল ঐশ্বর্ষ্যের আমরা যথাযথ ধারণাই করতে পারি না, পিতৃদেবের মুখে গুনেছি যে পিতামহ যখন বিলাতে অবস্থান