পাতা:প্রবাসী (পঞ্চত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৮৯৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চৈত্র সবাই সমান হ’লে সংসার চলে না। ছোট একটা পরিবারেও ত দেখ যে কেউ উপরে কেউ নীচে ।” মমতা বাপের যুক্তি মানিল না, বলিল, “তাই বলে মানুষ হয়ে যারা জন্মেছে, তারা মানুষের মত থাকতে পারবে না ? ওদের অবস্থা ত শেয়াল কুকুরেরও অধম । ওদের জন্তে নিশ্চয় কিছু করা উচিত।” যামিনী ক্রমেই তর্কের গতিক দেখিয়া শঙ্কিত হইয়া উঠতেছিলেন। মমতা অত্যন্ত উত্তেজিত হইয়াছে এবং স্বরেশ্বরও রাগিতে আরম্ভ করিয়াছেন। একটা তুমুল কাও বাধিয়া যাইতে পারে, তাহাতে মমতার কিছু লাভ হইবে না। স্বরেশ্বরেরও শরীর মুস্থ নয়, বেশী রাগারগি করিলে অনিষ্টেরই সম্ভাবনা। কিন্তু ইহাদের থামান যায় কিরূপে ? স্বরেশ্বরের কিন্তু মেয়ের সঙ্গে তর্ক করিবার তত ইচ্ছা ছিল না। যাহা নিজে মিথ্যা বলিয়া জানেন, ভাষার জোরে তাহাকে সত্য বলিয়া প্রমাণ করার মত বিদ্যা তাহার ছিল না । স্ত্রী হইলে না-হয় চীংকার করিয়া, বকিয়া, থামাইয়া দেওয়া যাইত, কিন্তু মেয়ের সঙ্গে ঠিক সে-রকম ব্যবহার করা চলে ন । সুতরাং তিনি অতি গম্ভীর ভাবে বলিলেন, “ওসব চেষ্টা করতে গেলে অনেক ভেবে করতে হয়। হুটু ক'রে কিছু করতে গেলে উভয় পক্ষেরই ক্ষতি।” পাছে মমতা আরও কথা বাড়ায়, এই ভয়ে তিনি তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করিয়া উঠিয়া চলিয়া গেলেন । মমতা খানিক ক্ষণ অস্বাভাবিক রকম মুখ ভার করিয়া বসিয়া রছিল, তাহার পর সেও টেবিল ছাড়িয়া গুইতে চলিয়া গেল । পর দিন সকালে আর কাহারও সমাজতত্ত্ব আলোচনার সময় রহিল না । স্বরেশ্বর দুই দিনের জন্যও কোথাও গেলে এমন পরিমাণ সোরগোল বাধিয়া যায় ষে লোকে মনে করে সেনানী পণ্টন এক দেশ হইতে আর এক দেশে চলিয়াছে। ভোর হইতে বেলা নট-দশটা পৰ্য্যস্ত কাহারও আর নিশ্বাস ফেলিবার সময় রছিল না । অবশেষে স্বরেশ্বর খাইয়া-দাইয়া বখন হাতীতে চড়িলেন, তখন বাড়ির লোক ইফি ছাড়িয়া চিল । মমতার নাওয়া-খাওয়া কিছুতেই আজ আর মন নাই। সে কেবল অস্থির ভাবে ঘৰু জার বাহির করিয়া বেড়াইতেছে। জন্মস্বত্ব tూ^9్స যামিনী তাহাকে ভাকিয়া বলিলেন, “ওরে, স্বান ক'রে ছুটে খেয়ে নে, শেষে কি একটা অস্থখ-বিমুখ বাধাবি ?” একটা ঝি মমতার চুলে তেল দিবার জন্ত বাটি হাতে করিয়া আসিয়া দাড়াইল, বলিল, “এখনও সব রান্না হয় নি, এই ত সবে হাট থেকে আনাজপাতি নিয়ে এল।” এখানে সপ্তাহে দুই দিন হাট হয়, তাহারই উপর তিন চার খানি গ্রামের নির্ভর । হাটের দিন ছাড়া অন্ত দিনে কোথাও কিছু পাইবার উপায় নাই । যামিনীদের সংসারে অবগু এসব অসুবিধা অনুভব করিবার উপায় নাই, কিন্তু গ্রামবাসীরা এ দুঃখটা বেশ পুরাপুরি ভোগ করে। যামিনী বলিলেন, “তা হোক, ও স্বান ক'রে আসুক। তত ক্ষণে সব রান্না হয়ে যাবে।" বলিয়া তিনি রায়াধরের দিকে চলিয়া গেলেন । দুই জন চাকর তখন রান্নাঘরের প্রশস্ত রোয়াকের উপর ঝুড়ি হইতে চাল, চিড়া, শাক তরকারি সব নামাইয়া রাখিতেছে । ঠাকুর একটা ক্লইমাছ হাতে করিয়া আন্দাজ করিতে চেষ্টা করিতেছে যে সেটার ওজন কত । যামিনী জিজ্ঞাসা করিলেন, “এর চেয়ে ছোট মাছ ছিল না ? এটা ত অন্ততঃ চার পাচ সের হবে। এত মাছ কে খাবে এক দিনে ?" চাকর হারু উত্তর দিল, “কোথায় মাছ মা-ঠাকরুশ ? মাত্তর চাট্টিখানিক জিনিষ এসেছে হাটে । জলে সব ক্ষেতখামার ভেসে গেল মানুষের, কেই বা জিনিষ আন্‌ছে আর কেইবা কিনছে ? মাছ এই রকম ছুটে এসেছিল, একটা আমি নিলাম, আর একটা ঐ ডোমপাড়ার ছোকুর বাবুরা নিতে যাচ্ছিল তা নায়েববাবু ই ই ক'রে এসে জেলের হাত থেকে মাছ কেড়ে নিলেন। বাবুরা আজ ফেনভাত খাবেন এখন—বাবুমশায় নাকি হাটের সব লোককে বারণ ক'রে দিয়েছেন তাদের জিনিষ বেচতে । প্রজ ক্ষ্যাপানোর মজ বুক্সন এখন কলকাতার বাবুরা।" যামিনী ধমক দিয়া বলিলেন, “বাজে বকৃতে হবে না, যা করছিস্ তা কর।” স্বামীর কীৰ্ত্তি গুনিয়া তাহার ত চক্ষু স্থির হইবার জোগাড় হইয়াছিল। পিছন হইতে হঠাৎ ধরাগলায় মমতা বলিয়া উঠিল, “দূর করে ফেলে দাও ও মাছ মা, চাই না আমরা খেতে । আমরাও মুনভাত খাৰ ।”