পাতা:প্রবাসী (পঞ্চদশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).pdf/১৮৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

S)8\ა স্থিতি-লয়ের বৃত্তান্ত । আমরা উৎপত্তি জানিতে পারি না ; কোন নিসর্গজ বস্তুর উৎপত্তি জানি ? যদি বলি ছোটনাগ: পুরের কোল-জাতি বেদের সময় ছিল, এবং তৎকালে দস্থানামে আখ্যাত হইত, তাহ হইলে স্থিতির একাংশ, অতীতাংশ, অতীতাংশের এক ক্ষুদ্রাংশ বুঝিলাম, উৎপত্তি বুঝিলাম না। প্রাচীন কোলের যে দস্থ্য ছিল, কিংবা বেদের দম্ব বৰ্ত্তমান কোলজাতির পূর্বপুরুষ, ইহা প্রমাণের নিমিত্ত প্রাচীন হইতে বৰ্ত্তমানকাল পর্য্যন্ত মাঝে মাঝে নিদর্শন চাই। কটকে একটা নদী আর সমুদ্রতীরে একট। নদী দেখিলে যেমন বলিতে পারি ন৷ দুই নদী একেরই দুই অংশ, তেমন এখানেও পারি না। সমস্ত নদী ন দেখি, মাঝে মাঝে যোগ দেথা চাই। এই যোগ দেখিতে না পরিলে, বৈজ্ঞানিকবিন্যাস না থাকিলে, ইতিহাস উপকথা श्नः । বাস্তবিক এমন জাতি কদাচিৎ দেখা যায়, যাহা বহুকাল অন্য জাতির সংসর্গে থাকিয়া ও স্বতন্ত্র রহিয়াছে। কেননা, সেজাতি স্বাতন্ত্র্য আকাজক্ষা করিলেও পাশ্ববৰ্ত্তী জাতি তাহ ভঙ্গ করিতে পারে, দৈবঘটনায় হইতে পারে। বহু কোল খ্রিষ্টান হইয়াছে। তাহার। সকলেই স্বেচ্ছায় খ্রিষ্টান হইয়াছে কি না কে জানে। যদি বা হইয়া থাকে, খ্রিষ্টান পাদরি না গেলে খ্রিষ্টান হইত না। এইরূপ, যে জাতির ইতিহাস দেখি, তাহার কোন চেষ্টার ইতিহাস, ধৰ্ম্মবিশ্বাসের ইতিহাস, রীতিনীতির ইতিহাস, সাহিত্যের ইতিহাস দেখি, তাহার সহিত পার্শ্ববৰ্ত্তীর্জাতির ইতিহাস জানিতে বুঝিতে হইবে। ইতিহাস অদ্যাপি বিজ্ঞান-পদবী পায় নাই। ইহার কারণ ইহা নহে যে বিজ্ঞান ও ইতিহাসের মূলগত পার্থক্য আছে। ইতিহাসে সংশয় আছে, বিজ্ঞানেও আছে। কারণ এই, মানবের ইতিহাস, মানোবিজ্ঞান অত্যন্ত জটিল ; বহুমানবগোষ্ঠীর জাতির ইতিহাস আরও জটিল । এই প্রবন্ধের প্রথমে ইতিহাসের প্রয়োজন উল্লেখ করিয়াছি । এক প্রয়োজন, আমাদের স্বাভাবিক ঔ২সুক্যের নিবৃত্তি। ইহার কারণ আর কিছু নহে, আমি আমার ক্ষেত্র বুঝিতে চাই। আমি আছি, কিন্তু এক নই। আমার মুখদুঃখ অন্তের কৰ্ম্মম্বারা বাধা প্রাপ্ত হয় ; আমি এই অন্যের, আম-ছাড়া মানবের স্বভাব চরিত্র প্রবাসী—আষাঢ়, ১৩২২ -l-l. - - [ ১৫শ ভাগ, ১ম খণ্ড বুঝিতে চাই। কাহার সহিত বাস করিতেছি, তাহ জানি৷ নিজের দুঃপের মাত্র অল্প মুখের মাত্র অধিক করিক্তে চাই । এইকারণে দেশের ইতিহাস জানিতে চাই। দেশে কে ছিলেন, কেমন ব্যবহার করিতেন, তাহার বংশ আছে কি না, থাকিলে সে বংশের চরিত কেমন, ইত্যাদি আমার প্রতিবেশীর আদ্যন্ত স্বভাবচরিত জানিতে চাই। মানব-ছাড়া যে দেশ, তাহার জ্ঞান ভূগোলে পাই । অতএব ইতিহাস ও ভূগোল আমার বিচরণ-ক্ষেত্রের বিবরণ। প্রাণরক্ষাথে যেমন আমার দেহতত্ব জানা আবশ্বক, তেমন আমার দেশের ইতিহাস ও ভূগোল জানা আবশ্বক। কারণ আমি'র জ্ঞান, আমি'র ক্ষেত্র-জ্ঞানের সহিত সম্বন্ধ। আমার ক্ষেত্র বুঝিবার সম্ভাবনা দেখিয়া আমি আমার দূরবত্তী দেশের ইতিহাস ও ভূগোলও অবগত হইতে চাই, দ্বিতীয় প্রয়োজনে আসিয়া পড়ি, জ্ঞাত হইতে অজ্ঞাতে, অতীত ও বর্তমান হইতে ভবিষ্যতে প্রবেশ করিতে চাই। ঘে ইতিহাস ও ভূগোলে আমার ভবিষ্যং বুঝিবার সাহায্য ন। পাই, তাহা আখ্যান হইতে পারে, ইতিহাস হইতে পারে না । তেমনই যে বিজ্ঞানে জ্ঞাত হইতে অজ্ঞাতের, বৰ্ত্তমান হইতে ভবিষ্যতের সূচনা না থাকে তাহা বিজ্ঞান নহে, তাহ দ্রব্য-গুণ-কৰ্ম্মের তালিকা। অদ্যাপি বৈজ্ঞানিক ইতিহাস রচিত হইতে পারিয়াছে কি না জানি না হইবে কি ন সন্দেহ। কারণ যে ক্ষেত্রে মানবজাতি বাস করিতেছে সে ক্ষেত্র পৃথক করিয়া প্রত্যেক অংশের কার্য নিরূপণ অসাধ্য। গোটাকয়েক স্থূলকথা অবশু আছে। যেমন রাজা অত্যাচারী হইলে প্রজাও হয়, যেমন এক জাতি অন্যের সংসগে না আসিলে স্বয়ং ভাল কিংবা মন্দের দিকে যায় না, ইত্যাদি । কারণ ক্ষেত্র বুঝিতে গেলেই ক্ষেত্রস্বামী বুঝিতে হয়। ক্ষেত্র-স্বামী মানবের চরিত্র বোঝা সহজ নহে। এই শিষ্ট শান্ত জাতি, বিদ্য ও বুদ্ধিতে পণ্ডিত-জাতি , তাহার মধ্যে একজন দুর্দান্ত হইয়া উঠিল। এই দুৰ্দ্দান্ত জাতি, তাহার মধ্যে একজন শান্তিপ্রিযু বৈরাগী জন্মগ্রহণ করিল, এমন হইল যে সেজাতির মতিগতি পরিবর্ত্তিত হইয়া গেল। মুসলমানরাজত্ব-সময়ে কে জানিত চৈতন্যদেব আবিস্তৃতি হইয় দেশে প্রেমরসের প্রবাহ চালাইয়া দিবেন। মোগল ৩য় সংখ্যা ] রাজ্য বেশ চলিতেছিল ; কে জানিত ঔরঙ্গজেবের প্রবল প্রতাপে সব উলট-পালট হইয়া পড়িবে। জীববিদ্যাতেও ঠিক এইরূপ অসম্ভাবিত জীবের উৎপত্তি হইতে দেখা যায়। ঝাড়ের বঁাশ হইতে হঠাৎ একটা বঁাশ দীর্ঘ হইয়| উঠিল, যেন প্রকৃতির কৃদন। এইরূপ, মানবসমাজে এক এক মাহ্য প্রকৃতির কুর্দন-স্বরূপ। কে জানিত কালাপাহাড় কুর্দন করিতে জন্মিবে। এই যে কর্দন, এই যে কেলি তাহ। গণিয়৷ বলিবার নহে ; কখন আসিবে, কি আকারে দেপা দিবে, তাহ কেহ জানে না। এই অসম্ভ ৷ কাও না ঘটিলে সব দেশের ইতিহাস প্রায় একরূপ হইত। অবশ্য ক্ষেত্রভেদে প্রান্তর-পৰ্ব্বত নদ-সমূদ্র শীত-গ্রীষ্ম ভোজ্য-পানীয় প্রভৃতি ভেদে লোকচরিত্র প্রভেদ হইবে। গ্রীষ্মদেশের গাছ শীতদেশে বাড়ে ন, মরিয়া যায়। মানুষ মরে না, কারণ মানুষ বুদ্ধিশালী, বুদ্ধিবলে প্রকৃতির পরিবর্তন অগ্রাহ করিতে পারে। কিন্তু কোন দিকে কোন মানুষের বৃদ্ধি খুলিবে তাহ কতক জানিতে পারা যায়, কতক পারা যায় না। উর্বরভূমির নদী-মাতৃকা-ভূমির মাত্য অলস হইয় পড়ে, সমুদ্রবেষ্টিত দ্বীপের মানুষ ধীবর হয়, পাৰ্ব্বত্যদেশের লোক কষ্টসহিষ্ণু হয়, ইত্যাদি কয়েকটা স্থলবৃত্তান্ত জানা যাইতে পারে। কিন্তু এসব ছাড়া মানুষ ইচ্ছা করিয়া দশজনের সহিত মন্ত্ৰণ করিয়া এক এক বিধি ব্যবস্থা চালাইতে পারে, যাহার ফলে সে মানুষ অন্য হইতে পৃথক হইয়া পড়ে। এই কারণে এই দৈব-হেতু মানুষের ইতিহাসে বিজ্ঞানের সুন্ধত অসম্ভব হইয়াছে, ইতিহাস বহুপরিমাণে লেখকের বিতর্কে পূর্ণ হইতেছে, “বোধ হয় হইয়াছিল" "বোধ হয় হয় নাই” ইত্যাদি “বোধ হয়" পুনঃ পুন: লিখিত হইতেছে। যখন "বোধ হয়"-এর ছড়াছড়ি তখন সত্য অপ্রকাশিত। এইকারণে, “কাহার বোধ হইয়াছে” “কে বলিতেছে", ইহা জানা আবশ্যক। অনেকস্থলে এক জনের, যিনি আপ্ত নহেন এমন একজনের, “বোপ হয় ইতিহাসের নামে লোকে পড়িতেছে। ইতিহাসকে একটা স্বরম্য হম মনে করা যাইতে পারে। হর্মা-নিৰ্ম্মাণের নিমিত্ত ইট পাথর কাঠ লোহ প্রভৃতি উপাদান চাই, প্রত্যেক উপাদানের দৃঢ়তা পরীক্ষা ইতিহাসের ক্রম •o8ጓ করা চাই, কে সে উপাদান সংগ্ৰহ করিয়াছে, কে পরীক্ষা করিয়াছে, কবে পরীক্ষা করিয়াছে, ইহা উপাদানের গায়ে ছাপ মারিয়া দেখাইয়া দেওয়া চাই। ইহার অভাবে তথ্য কি শোনা কথা, গল্পকথা কি মনগড়া কথা, কিছুই বুঝিবার উপায় থাকে না। যিনি যে ইতিহাসই লিখুন, যত বৃহৎ ইতিহাসই লিখুন, তাছাকে আপ্ত স্বীকার করিতে পারি না। তাহার বিতর্ক রাপিয়া দিয়া তিনি পরীক্ষিত প্রমাণিত তথ্যগুলি পর পর সাজাইয়া গেলে পাঠক নিজে ইতিহাস রচনা করিতে পারেন। পাঠকের সাহায্যের নিমিত্ত ইতিহাসকার উপাদানগুলি যথাযোগ্য স্থানে বসাইয়া নিজের কল্পনা দ্বারা গাথিয়া সুরম্য অট্টালিকা নিৰ্ম্মাণে প্রয়াসী হন। প্রাচীন ভারতের অৰ্ব্বাচন ভারতের ইতিহাসের বহু উপদান এখানে ওখানে বিক্ষপ্ত লুক্কায়িত অপ্রকাশিত আছে, কিন্তু ইতিহাসের সুরম্য হর্ম নিৰ্ম্মিত হয় নাই। এইকারণে আমরা বলি আমাদের দেশের ইতিহাস নাই। ইহার এমন অর্থ নহে যে, ইতিহাসের উপাদান নাই। আবশ্বক যাবতীয় উপাদান না থাকিতে পারে ; শিল্পী দুই পাচটা উপাদানের অভাবেও মনোহারী আটালিকা নিৰ্ম্মাণ করিতে পারেন। অতএব ইতিহাস রচনা যার-তার কৰ্ম্ম নহে। যে-সে স্থপতি ভূবনেশ্বরের মন্দির গড়িতে পারিত না। আমি ইতিহাস পড়িতেছি, কিংবা দুই দশটা উপাদান সংগ্ৰহ করিয়াছি বলিয়া আমার ঐতিহাসিকতা জন্মে না। আদালতে কত বিচারক নিত্য সাক্ষা গ্রহণ করিতেছেন, রায় প্রকাশ করিতেছেন, ঘটনা ব্যাখ্যা করিতেছেন। কিন্তু তাহ ইতিহাস নহে। কদাচিৎ কোনটা ইতিহাস, কোনট বিচারকের মত বা রায় ; অধিকাংশ ইট-কাঠের ঢিপি । এখানেও বিজ্ঞানের সহিত তুলনা করা যাইতে পারে। কত শত জন বিজ্ঞানের উপাদান সংগ্ৰহ করিতেছেন, সংগ্ৰহ করিয়া জীবন শেষ করিতেছেন, তা বলিয়া ভাইার বৈজ্ঞানিক নহেন। যিনি বিজ্ঞান-শিল্পী বিজ্ঞান-দার্শনিক, তিনি বৈজ্ঞানিক, অন্যে নহেন। তিনি বিপুল গ্রন্থ ন৷ লিখুন, তিনি সমুদায় উপাদান না জামুন, (সমুদ্ৰায় উপাদান ত জানিবার নহে ), বৈজ্ঞানিক হইতে পারেন। একারণ বৈজ্ঞানিককে কবি বলিতে পারা যায়, ঐতিহাসিককেও বলিতে পারা যায়। যেমন ছন্দ অনুসারে অক্ষর সাজাইয়।