পাতা:প্রবাসী (পঞ্চদশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).pdf/৩৮৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

१२o, বশিষ্ট ব্রাহ্মণবংশীয় ব্যক্তিবৃন্দের জীবনী বংশাবলী প্রভৃতি লেখা হইত। এই পত্নীগ্রন্থ হইতেই বিদ্যাপতির জীবনের অনেক কথা জানা গিয়াছে। যদিও মিথিলায় কখনও কৌলীন্য প্রথা প্রচলিত হয় নাই, সে পাপ হতভাগ্য বঙ্গদেশেই সীমাবদ্ধ ছিল, তপাপি সেখানেও সদ্বংশজাত গৃহস্থ যদি নিধন ও বৃদ্ধও হয় তথাপি সেইরূপ ঘরে কন্যাসম্প্রদান করিবার প্রথা ছিল। বিদ্যাপতির শিবগীতি হইতে আমরা সে কথা জানিতে পারি। এইরূপ বিবাহে দাম্পত্যজীবন যে খুব স্বর্থের হয় না কবি তাহাও উজ্জ্বলরুপে বুঝাইয়া দিয়াছেন। ঘর দেখিয়া বিবাহ দিলেন বটে, কিন্তু বিবাহের পর হইতেই হিমালয়ের মনে জামাতার প্রতি উপেক্ষার ভাব জাগিয়া উঠিল। মেনকার মনে দুঃখ, যে, জামাই ঘোড়া না চড়িয়া বলদে চড়ে, তাহার অর্থ নাই। মেয়ের স্বথে মায়ের মুখ; কন্যার মুখ হইবে না ভাবিয়া মা’র মন অস্থির। গিরিরাণীর জামাই বলদে চড়িয়া বেড়ায়, ইহাতে প্রতিবেশীর উপহাস করে, ইহাতে মেনকার খেদ ; মেনকা ইহা সহ করিতে পারে না, জামাইয়ের সঙ্গে কলহণ করে। জামাই কখনও মিনতি করে, কখনও রাগ করিয়৷ চলিয়া যায়। কঙ্ক গৌরী মুখ ফুটিয়া কিছু বলিতে পারে না, লজ্জায় মরিয়৷ যায় ; আবার পতি রাগ করিয়া চলিয়া গেলে তাহাকে খুজিয়া বেড়ায়। পতি যেমনই হউক, সতী স্ত্রীর পতিই সৰ্ব্বস্ব, তাই পিতৃগৃহে স্বামীর অপমানে মনে মনে গৌরী ক্লিষ্ট । এই তো গেল বাপের বাড়ীর কথা, তার পর নিজের ঘরেও গৌরীর “শতেক খোয়ার” । স্বামী নিধন, সৰ্ব্বদাই অভাব, অভাবের জন্য মনোমালিন্য। এখানেও প্রায়ই স্বামী রাগ করিয়া চলিয়া যান, গৌরী পথে পথে খুজিয়৷ বেড়ান, খুজিয়া পাইলে আহলাদে মগ্ন হন। স্বামী ভিক্ষা করিয়া বেড়ান, স্ত্রীর মাথা হেট হয়, তাই স্ত্রী স্বামীকে বলেন “ভিক্ষা করিয়া বেড়াও কেন,—তোমার গৌরবের হানি হয়,-দেখ তোমার ভাগ্যে ধুতুরার ফুল, বিষ্ণুর ভাগ্যে চাপা ফুল। ভিক্ষা ছাড়–কৃষি কর, ত্ৰিশূল কাটিয়া ফাল কর, বলদ জুতিয়া দাও, গঙ্গার জলে পাট কর।” গৌরী রাজার মেয়ে, সাংসারিক জ্ঞান তাহার মন্দ ছিল না, "ভিক্ষায়াং নৈৰ নৈবচ" এ তথ্য তিনি প্রবাণী—আশ্বিন, ১৩২২ ヘベヘヘヘヘヘヘヘヘヘヘヘヘヘヘヘヘヘヘヘヘヘヘヘヘヘヘヘヘヘヘヘヘ_ペ、ヘヘヘヘヘヘヘヘヘヘヘヘヘヘへ { ১৫শ ভাগ, ১ম খণ্ড জানিতেন ও আপাতত: প্রাণে প্রাণে তাহ বিলক্ষণ অনুভব করিতেছিলেন । যে কাল পড়িয়াছিল সে কালে ব্রাহ্মণেরও আর ভিক্ষ দ্বারা জীবিকাfনৰ্ব্বাহ করা কঠিন হইয়া উঠিয়াছিল। এইসকল কথা ভাবিয়া চিন্তিয়, সবদিক দেখিয়া গৌরী স্বামীকে আপদ্ধৰ্ম্মরূপে কৃষিকার্য্যে প্ররোচিত করিতেছেন। তখন বোধ হয় অনেক ব্রাহ্মণই কৃষিকাৰ্য্য করিতেন—অধ্যাপনায় সকলের চলিত না। কিন্তু গেীরীর এই সুন্দর উপদেশ তাহার “উমতা" পতির সম্বন্ধে বিশেষ কার্যকর হইল না। কথায় বলে “স্বভাব যায় মলে’ । মহাদেবের ভিক্ষা করাটা স্বভাবে পরিণত হইয়াছিল, তাই গৌরীর উপদেশ তিনি কানে তুলিলেন না বোধহয়, কারণ ইহার পরেও র্তাহাকে ভিক্ষাতেই প্রবৃত্ত দেখিতে পাই । মহাদেবকে কবি বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ রূপেই চিত্রিত করিয়াছেন ; কারণ যখন পঞ্জীর উল্লেখ রহিয়াছে তখন কবির উদ্দেশু। তাহাকে ব্রাহ্মণ বলিয়৷ পরিচিত করা। এই বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের সংসারে ভোজনের অংশী হইয়া দুইটি পুত্রের আবির্ভাব হইল—স্কুলোদর গণেশ এবং স্বপুরুষ কাৰ্ত্তিক। বুড়া বাপ ভিক্ষা করিয়া আনেন আর ছেলেরা বসিয়া বসিয়া থায় । বৃদ্ধের মনে ইহাতে বিরক্তির উদয় হয় । একদিন বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ ভিক্ষাটনে পরিশ্রান্ত হইয়া ঘরে ফিরিলেন এবং গণেশকে দেখিয়াই তাহার উপর তম্বি আরম্ভ করিলেন —“আমি বুড়া বাপ, আমি প্রতিদিন ভিক্ষা মাগিয়া ফিরিব, তোমরা কেহ সাহায্য করিবে না, বসিয়া বসিয়া খাইবে, আমি গেলে কি হবে, তখন কি ইহকালে উপবাস করিয়া পরকালের কাজ করিবে ?” জগতে মা’র প্রাণ সৰ্ব্বত্রই সমান, মা’র প্রাণে পুত্রের “খোয়ার" সহ হয় না, তাই গৌরী স্বর করিয়া কোন্দল আরম্ভ করিলেন—“কেন অত বল, বাছা পেটের ভরে নড়তে পারে না, তুমি ওকে দেখতে পার না তাই অত বল, তার চেয়ে দাও না ওকে বিদায় করে, আমার নাম নিয়ে ভিক্ষে মেগে খাবে—সবাই দেখুক্ত কি কপাল করে এসেছি, মানুষের দুর্দশ হ’লে কতই হয়, নিজের ছেলে, তার ওপর এত! ও গো লোক হাসিও ন}, লোক হাসিও না।” এর ওপর আর কথা চলে না, বুদ্ধস্ত তরুণী ভাৰ্য্যার শক্ত শাসন। - এ গেল আবদারের এক পাল । অপর পালা আরও ്~~................ -------- চমৎকার। এদিকে খাইবার সংস্থান থাকুক বা না থাকুক, ভিক্ষণ করিয়৷ থাইতে হয় হউক, মার মনে সর্থ তো আছে, একটি টুকটুকে বে। ঘর আলো করিয়া বেড়ায় এ ইচ্ছাটা কোন মা'র মনে না হয়। অতএব এবার গৌরী বুড়া স্বামীর কাছে আবদার ধরিলেন "ছেলে বড় হ’ল, আমাদের বয়স গেল, কবে ছেলের বিয়ে দেবে? অত বড় ছেলে কুমার, তোমার মনে কি চিন্তা হয় না ? লোকে বলবে হীন বংশের ছেলে, তাই অতদিন কুমার রয়েছে।” শিব হাসিয়া উত্তর দিলেন "বলি সব জেনে শুনে ন্যাক সাজ কেন ? দেথচ তে একটা ভাল মেয়ের সন্ধানে গায়ে গায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, তা তোমার ছেলের উপযুক্ত মেয়ে তো দেখতে পাই না।” কাৰ্ত্তিক আড়াল থেকে সব শুনিতেছিল, ক্রমে কলহ বা বাড়ে এই আশঙ্কায় তাড়াতাড়ি বাহির হইয়। মাবাপকে বলিতে লাগিল, “বাবা, মা, তোমরা ঝগড়া ক'র না, আমি বিয়ে করব না, আমার বিয়ের কাজ নাই, আমি কুমার থাকব।" এইরূপে সেযাত্র বিবাদের মীমাংসা হইল। আমরা জানিতে পারিলাম যে বিদ্যাপতির সময়ে সদ্বংশজাত সন্তানগণের বিবাহব্যাপার অল্প বয়সেই সমাপ্ত করিবার প্রথা প্রচলিত ছিল ; সে প্রথা বঙ্গেও অনেকদিন প্রচলিত ছিল, বোধহয় এখন আর ততটা নাই ; কিন্তু বিহারে এখনও খুব আছে। বয়স যদি বাড়িত তাহ হইলে লোকে কুল ধরিয়া নিন্দ করিত ; এখনও বঙ্গদেশে কন্যা সম্বন্ধে এ ভাব অনেকটা বিদ্যমান আছে। তারপর এই গৃহচিত্রের আর-এক অংশ বড় সরস। আমরা বলিয়াছি যে সংসারে দুঃখে পড়িয়া ঝগড়া কলহ হউক, কিন্তু গৌরীর মনে বুদ্ধপতির প্রতি অনুরাগ কম ছিল না। কবি ইহার পরবর্তী কবিতায় স্বামী লইয় গৌরী ও লক্ষ্মীর বিবাদ বর্ণনা করিয়াছেন, লক্ষ্মীর মুখে স্বামীর নিন্দ শুনিয়া গৌরী তাহার কড়া প্রতিবাদ করিতে ছেন, আবার লক্ষ্মী দুকথা শুনাইতেছেন ; এই প্রকারে দুইটি রমণীর কলহের ছবি কবি আঁকিয়াছেন । এ একটি সংসারের খাটি চিত্র। এ সংসারে অনেক রমণী এমন আছে যাহারা নিজের সৌভাগ্যগর্বের পরিচয় দিবার জন্য হয় প্রতিবেশিনীর স্বামীর সাক্ষাং নিন্দাবাদ করে, নয় সহায়ভূতির ছলে নিজ গৰ্ব্বের প্রকাশ করে। লক্ষ্মী আর গৌরী বিদ্যাপতির শিবগীতি --SumitaBot (আলাপ)-സ-- ԳՀ) ാ নাম দেবতার বটে, কিন্তু চরিত্র দুইটি রমণীর ; তা এই হরপাৰ্ব্বতী-সঙ্গীতে কবি দুএকটা নমস্কার বা প্রার্থনাবাকা প্রয়োগ করিলেও তিনি যে নিত্যদৃষ্ট মনুষ্যচরিত্রই অঙ্কিত করিয়াছেন সে বিষয়ে মতভেদ হইবার সম্ভাবনা নাই । যাহা হউক এ চিত্রের পরিসমাপ্তি আনন্দে। কলহাদি শেষ করিয়া সকলে মিলিয়া মিশিয়া ফাগ খেলিয়া সময়টা আনন্দে কাটাইতেছেন, এই দৃশ্বে কবি তাহার হরপাৰ্ব্বতীসঙ্গীত সমাপ্ত করিয়াছেন। তারপর প্রার্থন, সেটুকু এই গৃহচিত্রের বহিভূত। এই প্রার্থনার ভিতর এমন একটা পদ আছে যাহা হইতে সাহিত্যপরিষং হইতে প্রকাশিত বিদ্যাপতির পদাবলীর স্বযোগ্য সম্পাদক ত্রযুক্ত নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত বলিতে চাহেন যে বিদ্যাপতির শৈবত্ব প্রতিপাদিত হয়। এই পদে যে তাহার শিবভক্তি প্রকাশিত হইয়াছে সে বিষয়ে সন্দেহ নাই, কিন্তু ইহা দ্বারাই নিঃসংশয় প্রমাণ হয় না যে বিদ্যাপতি শৈব ছিলেন । সে কথা যাউক—আমরা যে চিত্রের কথা বলিতেছি তাহারই বিষয়ে আরও দু-একটা কথা লক্ষ্য করিবার আছে। প্রথম এই পদগুলির ভাষা। একটু প্রণিধান করিয়া দেখিলেই বুঝা যাইবে যে বিদ্যাপতি তাহার কৃষ্ণসম্বন্ধীয় পদাবলীতে যে ভাষা ব্যবহার করিয়াছেন তাহার সহিত এই গীতাবলীতে ব্যবহৃত ভাষার বিলক্ষণ পার্থক্য আছে। পার্থক্য স্পষ্টতঃ বিষয়গত ; প্রথমশ্রেণীর পদাবলীগুলি একটা গুঢ় রূপক, সেইজন্য তাহার ভাষা অলঙ্কারও সংস্কৃতবছল ; দ্বিতীয়শ্রেণীর পদাবলী একটা গৃহটিৰ অতএব ভাষাও তেমনি ঘরোয়, ইহাতে সাজসজ্জা নাই, কেবল সহজ সরল কথা সংসারের একটি কক্ষণোম্বল শু আমাদের সমক্ষে স্থত হইয়াছে। প্রথমটি কাব্য-বিভীষ্টি নাটক। রাধাকৃষ্ণ সম্বন্ধীয় পদাবলীতে বিদ্যাপতির কাব্যশির চরমে উপনীত হইয়াছে, শিবপাৰ্ব্বতী সম্বন্ধীয় পদাবলীতে র্তাহার সাংসারিক বুদ্ধি ও খুঁটিনাটি দেখিবার শক্তি বেশ পরিস্কট হইয়াছে। একটিতে একটা উচ্চভাবের পরিণতি অপরটিতে নিত্যদৃষ্ট সাংসারিক ব্যাপারের যথাযথ চিত্র, ছোটকথা ছোটভাব সোজাভাষায় বণিত। বিদ্যাপতির ভাষা হইতে, ভাষাতত্ত্ববিষয়ক যে-সকল তথ্য আবিষ্কার করা যায় তাহ এ প্রবন্ধের প্রতিপাদ্য নহে—অন্য কোনও সময়