পাতা:প্রবাসী (পঞ্চদশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).pdf/৪২১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৭৮৬ যেমন ঠাও পাইলে নিস্তেজ হয়, বিষে মৃতপ্রায় হয় এবং ঔষধে পুনর্জীবিত হয়, ধাতুপিণ্ডেও ঐ-সকল প্রক্রিয়ায় অবিকল একই ফল প্রকাশ হইয়। পড়িয়াছিল। সজীব মাংসপেশীতে চিমটি কাটিলে তাহ বেদনায় উত্তেজিত হয় এবং সঙ্গে-সঙ্গে সেখানে বিদ্যুতের উৎপত্তি হয়। ধাতুপিণ্ডে চিম্টি কাটিয়া জগদীশচন্দ্র ঠিক সেই প্রকার বেদন-জ্ঞাপক বিদ্যুতের উৎপত্তি দেখিয়াছিলেন। মাংসপেশীতে পুন: পুনঃ আঘাত দিলে তাহা অসাড় হইয়া যায়, কিন্তু বিশ্রামের অবকাশ দিলে তাহাতেই সাড়া দিবার শক্তি আবার ফিরিয়া আসে। অবিরাম আঘাত দিয়া জগদীশচন্দ্র ধাতুপিণ্ডেও ঠিক ঐ প্রকার অসাড়ত। দেখিতে পাইয়াছিলেন এবং বিশ্রামের অবকাশ দিয়া তাহাকেই আবার সসাড় করিয়া তুলিয়াছিলেন। - আঘাতে সাড়া দেওয়াই জীবের জীবত্ব বলিয়া যে একটি সংস্কার স্মরণাতীত কাল হইতে বদ্ধমূল ছিল, বস্তু মহাশয়ের পূৰ্ব্বোক্ত আবিষ্কারে তাহার উচ্ছেদ হইয়াছিল। সকলে বুঝিয়াছিলেন, অজৈব পদার্থ মাত্রই মৃত নয়। এই আবিষ্কারের বিবরণ রয়াল সোসাইটি প্রভৃতি বিজ্ঞান-সভায় প্রচারিত হইলে বৈজ্ঞানিকগণ জগদীশচন্দ্রকে কি প্রকারে সম্মানিত করিয়াছিলেন, আমরা পূর্বেই তাহার আভাস দিয়াছি। আর কোনো গবেষণায় হাত না দিয়৷ তিনি যদি এইখানে সকল গবেষণা হইতে বিরত হইতেন, তাহা হইলে পূৰ্ব্বোক্ত আবিষ্কারটিই জগদীশচন্দ্রের নাম বিজ্ঞানের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় করিয়ু। রাখিত। কিন্তু সম্মানলাভ তাহার গবেষণার লক্ষ্য ছিল না, প্রকৃতির কাৰ্য্যের মূল রহস্ত আবিষ্কার করিয়৷ সমগ্র স্বষ্টির সহিত পরিচয় লাভ করাই তাহার জীবনের সাধনা হইয়াছিল । কাজেই এত সম্মান এত সাধুবাদ তাহাকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করিতে পারে নাই। তিনি ভাবিতে লাগিলেন, ধাতুর সহিত সাধারণ সজীব বস্তুর যখন এত নিকট সম্বন্ধ, তখন সাবধানে পরীক্ষা করিতে পারিলে উদ্ভিদ ও প্রাণীর জীবনের কাৰ্য্যে নিশ্চয়ই অনেক মিল দেখা যাইবে । উদ্ভিদের জীবনের কার্য্য পরীক্ষা করিবার জন্য এপর্য্যস্ত জীবতত্ত্ববিদগণ অনেক যন্ত্র উদ্ভাবন করিয়াছেন, কিন্তু এই প্রবাসী-আশ্বিন, ১৩২২ সকল জগদীশচন্দ্রের নিকটে এত স্থল বলিয়া বোধ হইতে লাগিল যে, তিনি নিজেই মনের মত যন্ত্র প্রস্তুত করিতে নিযুক্ত হেইলেন। অল্পদিনের মধ্যে অনেক যন্ত্র প্রস্তুত হইল। এগুলি এত কার্য্যোপযোগী হইল যে, শীতগ্রীষ্মে বা আঘাতের উত্তেজনায় দৈহিক অবস্থার যে অতি সামান্য পরিবর্তন হয়, তাহাও উদ্ভিদগণ যন্ত্রের লেখনীর সাহায্যে যন্ত্র-সংলগ্ন লিপিফলকে 'লিথিয়া জানাইতে লাগিল । জগদীশচন্দ্ৰ দেপিলেন, কেবল জীবনমৃত্যু ক্ষয়বৃদ্ধি প্রভৃতি স্কুল ব্যাপারেই যে, প্রাণী ও উদ্ভিদের এঞ্চত আছে, তাহ নয় ; প্রাণীর জীবনের কার্যা যে সকল খুটিনাটি ব্যাপার দেখা যায়, সেগুলি উদ্ভিদেও ধরা পড়ে। চিমটি কাটিলে বা আঘাত দিলে প্রাণীর দেহে বেদনার সঞ্চার হয় এবং তাহার লক্ষণ দেহের আকুঞ্চনে বা বিদ্যুৎপ্রবাহে প্রকাশ পায়। তাজা ফুলকপির ডাটায় চিমটি কাটিয়া জগদীশচন্দ্র অবিকল সেই প্রকার বেদন-জ্ঞাপক লক্ষণ তাহার যন্ত্রে দেখিতে পাইয়াছিলেন । তা ছাড়া বিষ, মাদক দ্রব্য, অবসাদক বা উত্তেজক বস্তু প্রাণীদেহে ঘেপ্রকার ক্রিয় করে, উদ্ভিদদেহেও যে অবিকল তাহাই করে, জগদীশচন্দ্র ইহা প্রত্যক্ষ দেখাইয়াছেন। পরীক্ষাকালে উদ্ভিদগণ যন্ত্রের লেখনী দিয়া দৈহিক বস্থার কথা নিজেরাই লিথিয় দেখাইয়াছিল । শ্রমসাধ্য কাজ বার বার করিতে থাকিলে খুব বলশালী প্রাণী ও অবসন্ন হইয়। পড়ে। তখন তাহার বিশ্রামের প্রয়োজন হয়। বিশ্রামে অবসাদ দূর হইলে, আবার সে শ্রম করিতে পারে । জগদীশচন্দ্র উদ্ভিদকেও ঐ প্রকারে পরিশ্রান্ত হইতে দেখিয়াছিলেন এবং বিশ্রামের অবকাশ দিয়া তাহাকে কার্যক্ষম করিয়৷ তুলিয়াছিলেন। যে ঘোড়া গাড়ি টানিতে গিয়া বেশী লাফালাফি করে, সে শীঘ্রই পরিশ্রান্ত হয় ; কাজেই তাহার বিশ্রামেরও শীঘ্র প্রয়োজন হয়। লজ্জাবতী গাছে বসুমহাশয় ঐ প্রকার উত্তেজনাশীল প্রাণীর সকল লক্ষণই দেখিতে পাইয়াছেন। সামান্ত উত্তেজনায় লজ্জাবতী অধিক সাড়া দিয়া শীঘ্র অবসাদগ্ৰস্ত হইয়া পড়ে, অন্ততঃ পনেরো মিনিটকাল বিশ্রামের অবকাশ না দিলে সে পূর্বের স্ফৰ্ত্তি ফিরিয়া পায় না । [ ১৫শ ভাগ, ১ম খণ্ড I ৬ষ্ঠ সংখ্য। ] দেহে আঘাত দিলে আঘাতের সঙ্গে-সঙ্গেই প্রাণীর বেদন বুঝিতে পারে না। আঘাত-প্রাপ্তি ও বেদনঅনুভূতির মধ্যে এক একটু সময়ের ব্যবধান থাকে। উদ্ভিদেও আঘাত-প্রাপ্তি ও বেদনা-অনুভূতির মধ্যে যে একটু অবকাশ আছে তাহা ৪ জগদীশচন্দ্র তাহার যন্ত্রের সাহায্যে দেখাইয়াছেন। এমন সূক্ষ্ম-সময়- পরিমাপক যন্ত্র এপর্যন্ত কোনো বৈজ্ঞানিকই উদ্ভাবন করিতে পারেন নাই । মদ খাইয়। মাহয় যখন মাতাল হয়, তখন তাহার চালচলন কিপ্রকার অদ্ভূত হইয়া দাড়ায়, তাছা কথন কথন পথে ঘাটে দেখা যায়। জগদীশচন্দ্র কিছুকাল আলকোহল বাপের মধ্যে রাথিয়ু লজ্জাবতী লতাকে উন্মত্ত করাইয়াছিলেন এবং তাহতে একে একে মাতালের সকল লক্ষণই দেখিতে পাইয়াছিলেন। গাছের হাত পা নাই, বাকশক্তিও নাই ; কাজেই লঙ্গাবতী ঐ অবস্থায় মাতালের মত টলিতে পারে নাই বা উচ্ছম্বলভাবে হাসিকান্না দেখাইতে পারে নাই। কিন্তু যন্ত্রে সে নিজে যে-সকল সাড়া লিখিতে আরম্ভ করিয়াছিল, তাহতেই মাতালের সকল উচ্ছ,স্বলতার লক্ষণ একে একে প্রকাশ পাইয়াছিল।, ঠাণ্ড এবং নিৰ্ম্মল বাতাসের সংস্পর্শে মাতালের নেশা ছুটিয়া যায়। আলকোহলের বাষ্পপ্রয়োগ বদ্ধ করিয়া লজ্জাবতীকে নিৰ্ম্মল বাতাসে রাখা হইয়াছিল। ইহাতে সে কিছুকালের মধ্যেই প্রকৃতিস্থ হইয়া দাড়াইয়াছিল। কেরল মাদক দ্রব্য নয় ; যে দ্রব্য প্রাণীদেহে যে ক্রিয়াটি দেখায়, উদ্ভিদদেহে প্রয়োগ করায় বস্তমহাশয় অবিকল সেইক্লিয়াই দেখিতে পাইয়াছিলেন। এ পর্য্যন্ত জীবতত্ত্ববিদগণ প্রাণী ও উদ্ভিদকে দুইটি সম্পূর্ণ পৃথক্ জাতীয় জীব বলিয়া মনে করিয়া আসিতেছিলেন । তাহাদের জীবনের কার্য্যের মধ্যে যে কোনো ঐক্য আছে তাহা ইহাদের মধ্যে কেহই স্বীকার করিতেন না। বিজ্ঞানচার্ধ্য-জগদীশচন্দ্রের এই-সকল আবিষ্কারে এখন পণ্ডিতের বুঝিয়াছেন, প্রাণী ও উদ্ভিদের জীবনের কার্ধ্যে কোনো পার্থক্যই নাই ; বিধাতা উভয়কে একই গুণবিশিষ্ট করিয়৷ স্বষ্টি করিয়াছেন। বিচিত্র অবস্থার মধ্যে পড়িয়া সেই আদিম গুণগুলিই বিচিত্ররূপ গ্রহণ করিয়া আমাদের মোহ উৎপাদন করিতেছে। 〉や জগদীশচন্দ্রের আবিষ্কার ԳԵ.Գ., -o-o-o-o-o-o-o-o-o-o-o-o-o- ംാസസ്സ്.-- এগুলি খুবই উচ্চ অঙ্গের কথা। জগদীশচন্দ্রের আবিষ্কার আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের কাৰ্য্যে কতট। লাগিবে, তাহা চিন্তা করিলে দেখা যায়, এই হিসাবেও আবিষ্কারগুলির মূল্য কম নয়। চিকিৎসার জন্য ঔষধ নির্ণয় করা বড়ই কঠিন কাজ। কোনো পদার্থের রোগ নাশ করিবার শক্তি জানা গেলেও, তাহ মানুষের উপরে হঠাৎ প্রয়োগ করা যায় না। কাজেই অনেক নিরীহ প্রাণীর উপর দিয়া নূতন ঔষধাদির গুণাগুণ পরীক্ষা করিতে হয়। মাহুষের স্থবিধার জন্য এইপ্রকারে আজকাল যে কত প্রাণীহত্যা করিতে হইতেছে, তাহার ইয়ত্ত হয় না। এখন উদ্ভিদের উপরে পরীক্ষা করিয়া ঔষধের গুণাগুণ বিচার করা চলিবে বলিয়া মনে হইতেছে। জৰ্ম্মানির প্রধান উদ্ভিদতত্ত্ববিদ পেফার Pfeier) এবং হাবেরলাগু (Haberlandt) সাহেব নানা পরীক্ষায় লজ্জাবতীর ন্যায় উদ্ভিদেও স্বায়ুমণ্ডলীর অস্তিত্ব ধরিতে পারেন নাই। ইছারা লজ্জাবতীকে ক্লোরোফরমের বাম্পে রাপিয়া-- ছিলেন এবং তাহার ডাটা পুড়াইয়া দিয়াছিলেন, কিন্তু তথাপি লজ্জাবতী সাড়া দিতে ছাড়ে নাই। ইহা দেখিয়াই সিদ্ধান্ত হইয়াছিল যে, লজ্জাবতীর দেহে স্নায়ুমণ্ডলী নাই । থাকিলে তাহার কার্য্য ক্লোরোফরমের স্পর্শে ও তাপে লোপ পাইয়া যাইত এবং সঙ্গে-সঙ্গে লজ্জাবতীর সাড়া-দেওয়৷ বন্ধ হইত। আগুনে-পোড়া শাখার ভিতর দিয়া উত্তেজনার চলা-ফেরার কারণ দেথাইতে গিয়া ইহার বলিয়াছিলেন, জলপূর্ণ রবারের নলের একপ্রান্তে চাপ দিলে তাহাতে যেমন সেই চাপ নলের অপরপ্রান্তে গিয়া পৌছায়, লজ্জাবতীর দেহের উত্তেজনা ঠিক সেইপ্রকারেই দেহের ভিতরকার জলের সাহায্যে দগ্ধ শাখার ভিতর দিয়াও চলে। পেফার ও হাবেরলাণ্ডের পূৰ্ব্বোক্ত সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করিয়া জগদীশচন্দ্র যেসকল পরীক্ষা দেখাইয়াছেন তাহ। বড়ই আশ্চৰ্য্যজনক । তিনি একটি লজ্জাবতী গাছকে চার অবস্থা হইতে সাবধানে পালন করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। যাহাতে সেটি শীঘ্র শীঘ্র বাড়িয়া পুষ্টাঙ্গ হয় তাহার জন্য যখন যে ব্যবস্থা প্রয়োজন তখনি তাহ করা হইত এবং যাহাতে উহার পাতায় বা ডালে কোনো প্রকার আঘাত না লাগে, তাহার প্রতি সৰ্ব্বদা দৃষ্টি রাখা