পাতা:প্রবাসী (পঞ্চদশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).pdf/৮২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

> 88 স্বযোগ্য ভ্রাতুপুত্র নীরবে দেখে কেমন করিয়া ? কাজেই তাহাকে বাধ্য হইয়া বলিতে হয়, না হইলে তাহার কি মাথায্যথা? মাথা-ব্যথা যাহারই হোক, আব্দুর কেমন অসহ বোধ হইল। উভয়ে বচসা চলিতেছে, মাঝখান হইতে সে কল, কাপড়, কাচি, স্বচ, স্থত, সব গুটাইয়া তুলিয়া ফেলিল ; সংযত স্বরে বলিল, “যান বাবু যান, এত রাগারগির দরকার কি,-আমি ঘোড়া ঘুরিয়ে আনছি।" বাড়ীর সকলেই চাকরদের শ্রেণী হইতে আন্দুকে একটু স্বতন্ত্র চক্ষে দেথিত । কেননা সে লেখাপড়াও জানিত এবং রীতিনীতির জ্ঞানও তাহার যথেষ্ট ছিল। কঠোর প্রকৃতি ছিদ্রান্বেষী কিরণচন্দ্রও তাহাকে অনেকখানি শ্রদ্ধা করিত। কিন্তু আজ ক্রোধের মুখে গর্জনের মাত্রা সম্বরণ করিতে পারিল না, বলিল—“তোমার তো করবার কথা নয়, তুমি কেন ফফরদালালি করতে এসেছ ? যে নবারজাদার৷...” আন্দু নিজের দালালি করার কোমো কারণ দিতে পারিল না। বিপন্ন ভাবে সবিনয়ে বলিল—“হোক না বাবু, এরা সকাল থেকে গাড়ী ঘোড়ার পিছুতে ঢের খিদমদ খেটেছে। আমিই ঘোড়াটাকে দৌড় দিয়ে আনি ৷” উত্তপ্ত কিরণচন্দ্র গজ গ্রজ করিতে লাগিল। এতক্ষণ লতিকা নীরবে এক পাশে দাড়াইয়। বিদ্বেষপূর্ণ নয়নে কিরণের ভাবভঙ্গী লক্ষ্য করিতেছিল। সেই সময় সে হঠাৎ তাড়াতাড়ি অন্যত্র চলিয়া গেল । কিরণও চলিয়া গেল। আকবর রুদ্ধ আক্রোশে ফুসিয়৷ ফুসিয়া গর্জন করিতে লাগিল—সে অমন ঢের লাল চোখ দেপিয়াছে। আন্দু নরম স্বরে বলিল, "যেতে দাও দাদা, চল ঘোড়াটাকে দুরুস্ত করে আনা যাক্—” প্রবলবেগে মাথা নাড়িয়া আকবর বলিল—“আরে ন৷ না, সে আমি পারবই না! এক ফোটা ছেলে, কাল যাকে আমি হতে দেখলেম, তারই কথা শুনে কাজ ! কখনই नतः " * * আকবর আরো শক্ত হইয়া বসিল । রাগের চোটে তাহার গলা দিয়া কি যেন একটা ঠেলিয়া উঠিতেছিল । চৌধুরী-সাহেবের এতদিনের পুরানো চাকর সে, ভাহাকে প্রবাসী—বৈশাখ, ১৩২২ [ ১৫শ ভাগ, ১ম খণ্ড কি না পামক যখন-তথন এমনি তাড়াহুড়া –ইস্‌! না হয় সে চাকুরাই ছাড়িয়া দিবে, এত সে সহ করিতে পারে না। বছর থানেকের পরিচয় হইলেও, আন্দু আকবরকে বেশ চিনিয়াছিল, কিন্তু বকবিকিট। সে বড় অপছন্দ করিত। ক্ষুণ্ণমনে আকবরের মাথার চুলে হাত বুলাইতে বুলাইতে স্নেহময় কণ্ঠে আন্দু বলিল—“কি করবে বল দাদা, দুনিয়ায় সব লোক তো সমান নয়, পাচটা আঙ্গুল মাহুষের,-কেউ ছোট, কেউ বড়, তবু এই নিয়েই তো মাহুষকে কাজ চালাতে হয়। জান ত দাদা, জায়গা-বিশেষে চড়া বুলি শুনতেও হয়, আবার শোনাতেও হয় । ছেলেমানুষের কথায় রাগ করা কি তোমায় সাজে ! তুমি ত ওদের হাতে করে মানুষ করেছ...” আকবরের মন নরম হইয় গেল। আন্দুর কণ্ঠস্বরের ভঙ্গীতে সুদূর অতীতের সহস্র রঙীন ছবি তাহার চোখের সামনে ভাসিয়া উঠিল। ক্রোধ-উৎক্ষিপ্ত চিত্তের তিক্ততা অনেকটা প্রশমিত হইল। তাড়াতাড়ি উঠিয় দাড়াইয়া বলিল, “ঘোড় নিয়ে আমি যাচ্ছি, তুমি থাক।" “আরে না না, দাদা তাও কি হয় ! তুমি এখন জীরোও আমি যাচ্ছি—” আন্দুর কোমল সহৃদতায় আকবরের কঠিন অস্তরে মমতার সঞ্চার হইল, বলিল, “না না ভারি রোদের তেজ, তুমি থাক—” বাধা দিয়া সহস্তে আন্দু বলিল—“কিছু ভেবো ন দাদা, চাদের আলে, সুধির আলো আমার ঠিক সমানই বরদাপ্ত হয় –চাবুকটা দেবে চল ।” আকবরকে টানিয়া লইয়া আন্দু চলিল। আন্দুর সরল সহানুভূতিতে যদিও আকবরের অন্তর্নিহিত ঝাঝট চাপ পড়িয়াছিল কিন্তু সম্পূর্ণরূপে নয়। পথের পাশে কিরণের সখের কুকুরটা শুইয়৷ গাঢ় নিদ্রায় আরাম উপভোগ করিতেছিল, আকবর খাইবার সময় সেই নিরীহ প্রাণীটার পৃষ্ঠে এমন ভাবে চরণস্পর্শ করিয়া গেল যে কুকুরটা হঠাৎ জাগি৷ আৰ্ত্তরবে কেউ কেউ করিয়৷ ছুটিয়া পলাইল। আকবরের আচরণে আন্দুর মুখ গম্ভীর হইল। নূতন অনর্থ বাধিবার আশঙ্কায় সে তখনকার মত আর কিছু উচ্চ বাচ্য করিল না, কিন্তু তাহার অপ্রসন্ন দৃষ্টির নির্বাক T ১ম সংখ্য। ] l তিরষ্কারে আকবর মনে মনে বড় সঙ্কুচিত হইয়া পড়িল, আৰু মুখ ফুটিয়া ভৎসনা করিলে তাহার বুঝি সে লজ্জা ইত না। সে তাড়াতাড়ি চাবুক দিয়া নীরবে চলিয়া গেল। কুঠার সামনে ময়দানে দাড়াইয়া প্রকাও লাল ঘোড়ার গায়ে মাথা ঘসিয় তাহাকে একটু আদর করিয়া প্রসন্নমুখে ঈদ দিতে দিতে আন্দু ঘোড়ার মুখে লাগাম কসিল। তারপর ঘোড়াশালা হইতে নিদ্রিত সহিস রহিম খাকে ডাকিয়া জাগাইয়া তুলিল। রহিম বাহিরে আসিলে বলিল, “চাচা, তুমি আর ঘুমিও না, আমি আধঘণ্টার মধ্যে ফিরব। সাহেবের আফিস-ঘরখানা ঝাড়তে হবে, হরিহরের শরীর ভাল নেই।” লাফাইয়া ঘোড়ার অনাবৃত পিঠে চড়িয়া আন্দু ঘোড়া ছুটাইল। সচরাচর আন্দু ঘোড়ার মুখে লাগাম না দিয়া ঘোড়া ছুটাইত। ঘোড়ার ঘাড়ের কেশগুচ্ছ মুঠাইয়া ধরিয়া, কান ধরিয়া লাগামের অভাব সারিয়া লইত । বজাত ঘোড়াকেই শুধু লাগাম কসিত ; বিচিত্র কৌশলময় মোটর-কার ও দুরন্ত তেজস্বী অশ্ব, এই দুইটি তাহার জীবনের প্রধান কৌতুকের সামগ্রী ছিল। রহিম খা আড়ামোড়া দিয়া গা ভাঙ্গিল। এই দুপুর রৌদ্রে ঘোড়া লইয়া বাহির হওয়ায় আন্দুর উপর ভারি বিরক্ত হইল এবং এই বাহাদুরীর ফলে যে ছোকরাটি কোন দিন সগিৰ্ম্মি হইয়া মারা পড়িবে, সে সম্বন্ধে স্থিরনিশ্চয় করিয়া অসন্তুষ্ট রহিম খাবিড়বিড় করিয়া বকিতে বকিতে চলিয়া গেল। " আব্দুর জীবনের অতীত অধ্যায়ের কাহিনী একটু বৈচিত্র্যরঞ্জিত, বিস্ময়াবহ। তাহার পিতার ভাগলপুরে একটি মাঝারি রকম দর্জির দোকান ছিল। পিতা সচ্চরিত্র এবং অত্যন্ত ধৰ্ম্মভীরু নিষ্ঠাপরায়ণ লোক ছিলেন। সকলেই তাহাকে সবিশেষ শ্রদ্ধা করিত। অতি শৈশবে আন্দুর মাতৃবিয়োগ হইয়াছিল, কিন্তু তিনি তার দারান্তর গ্রহণ করেন নাই। পুত্রকে তিনি অল্প বয়স হইতে দর্জির কাজ শিখাইত আরম্ভ করেন। পুত্রের কিন্তু সে কাজে মন বসিল না, লেখাপড়ার উপর তাহার অদম্য কৌতুহল দেখিয়৷ পুত্রবৎসল পিতা-তেরো বছরের পরা তাহাকে স্কুলে পাঠাইলেন । | リ リ。 সেখ আন্দু আন্দু ঠিক পিতার মতই শুচিত-সম্পন্ন, স্বকোমলহৃদয় হইয়া উঠিয়াছিল। দরিদ্রের উপর তাহার করুণার সীমা • ছিল না, পিতার সহানুভূতিতে তাহার দয়া প্রবৃত্তির যথেষ্ট অনুশীলন করিবার স্বযোগও হইত। পিতা তাহার প্রায় কোন কার্য্যেই বাধা দিতেন না। ফলে ন্যায় অন্যায়ের মীমাংসার ভার নিজের উপর পড়ায়, সে বিকৃতবুদ্ধি স্বেচ্ছাচারী না হইয়া দৃঢ়প্রকৃতির স্বাবলম্বীরূপে গঠিত হইয়া উঠিয়াছিল। স্কুলে গিয়া, অখণ্ড অধ্যবসায়ী বালক শীঘ্রই প্রথম শ্রেণীতে উন্নীত হইল , তখন পিতা তাহাকে স্কুল ছাড়াইয়া জাতীয় ব্যবসায় অবলম্বন করিতে অনুমতি দিলেন। আন্দুর উংস্থক শিক্ষা-পিপাসা নিবৃত্ত হইল না, সে পিতার অজ্ঞাতে এক অভিজ্ঞ লোকের কাছে আরবী ফারসী শিখিতে লাগিল। কিছুদিন শিখিয়া সে বহু গ্রন্থ পাঠ করিয়া ফেলিল। এই সময়ে সাধু সন্ন্যাসী ফকির মহলে তাহার গতায়াত অত্যন্ত বৃদ্ধি হইল। পিতা উদ্বিগ্ন হইয়া ভাবিলেন, পুত্র বুঝি বা দেওয়ানা হয়। কয়েকজন বন্ধুর পরামর্শে তাহাকে স্থানান্তর করিবার উদ্দেশ্বে আগ্রায় একজন বিশিষ্ট লোকের কাছে চিত্রবিদ্যা শিথিতে পাঠাইলেন। কিছুদিন সেখানে চিত্রবিদ্যায় আব্দুর খুব ঝোক দেখা গেল। তাহার পর যেদিন শিক্ষক তাহার প্রশংসা করিয়া বলিলেন “তুমি সময়ে মস্ত নামজাদা হইবে”—সেই দিন তাহার সমস্ত উৎসাহের স্রোত নিঃশেষিত হইল, যাহা দুষ্প্রাপ্য তাহার উপরই আব্দুর আগ্রহ,—যাহা অনায়াস-লভ্য, তাহার আর বিশেষত্ব কি ? আন্দুর চিত্রবিদ্যা শিক্ষা ঐখানেই শেষ হইল। এই সময় তাহার পিতা তীর্থ দর্শনে বাহির হইলেন। আব্দুর উপর দোকানের ভার পড়িল ; আন্দু ভাগলপুরে আসিয়া দোকান চালাইতে লাগিল। সেই সময় কুস্তির উপর তাহার ঝোক পড়িল, সঙ্গে-সঙ্গে গান বাজনাতেও মাতিল। পিতারাদোকানের কাজ করিয়ানযেটুকু সময় পাইত, ঐসব চর্চায় কাটাইত একদিন একসাহেবের সহিত ঘুষি লড়িয় তাহাকে চমৎকৃত করিলা সাহেবের সহিত আলাপ হইলে আন্দু তাহাকে ধৱিয় মোটরগাড়ী