পাতা:প্রবাসী (প্রথম ভাগ).djvu/১৩২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৩য় সংখ্যা। ] কারণ তাহার নগ্ন দেহ দেখিলেই বুঝিতে পারা যায় যে তাহার শরীরে বিলক্ষণ সামৰ্থা আছে। সে ব্যক্তি যেন কিছুই শুনিতেছে না, লোহার হাতুড়ি দিয়া এক মনে পাথর ভাঙ্গিতেছে। সহসা স্ত্রীলোকটা দৌড়িয়া তাহাদের নৌকায় প্রবেশ করিল --নে.কাছাড়া অনেকের অন্য গৃহ নাই-ও কতকগুলা মলিন, জীর্ণ বন্ধখণ্ড আনিয়া স্বামীর সম্মুখে রাখিল। এ প্যান্টোমাইমের অর্থ এই যে যখন তুমি আমায় বিবাহ করিয়াছিলে, তখন তোমার এইরূপ দুদ্দশা ছিল, অঙ্গে বস্ত্র জুটিত না, আমার জন্য এখন তুমি পরিতে পাও। ষাঁড় সেমন লাল ন্যাকড়া দেখিলে রাগিয়া ওঠে ময়লা ন্যাকড়াগুলা দেখিয়া তাহার স্বামী সেইরূপ জ্বলিয়া উঠিল। হাতুড়ি ফেলিয়া, লাফাইয়া উঠিয়া, সকলকে গালি পাড়িতে লাগিল। ক্রোধে উন্মত্ত হইয়া সে ঘুরিয়া ঘুরিয়া নৃত্য করিতে লাগিল।

আমার নৌকার পাশে প্রথিতযশা বিবেকানন্দ স্বামীর নৌকা বাঁধা ছিল। এই সময় তাহাকে ডাকিলাম। তিনি বাহির হইয়া আমার নৌকায় আসিলেন। সে ব্যক্তি আবার গিয়া পূব্বের মত পাথর ভাঙ্গিতে লাগিল। তাহার স্ত্রী আবার নৌকায় গিয়া কতকগুলা হাড়ি লইয়া আসিল – অর্থ, তোমার এই রকম শুধু হাড়ি ছিল, পেটে ভাত ছুটিত না, এখন আমার জন্য থাইতে পাইতেছ। কিছুকাল এই রকম রূপক যুদ্ধের পর এক শ্যালক আসিয়া, ভগিনাপতির মুখের কাছে হাত নাড়িয়া গালি দিতে লাগল। বৃদ্ধ তখন ক্রোধ সম্বরণ করিতে না পারিয়া শ্যালককে চপেটাঘাত করিল। অমনি শ্যালকদ্বয়, ভগিনী ও ভগিনীপতি জড়াজড়ি করিয়া ভাঙ্গা পাথরের উপর পড়িল। পাশে অনেক লোক দাঁড়াইয়া দেখিতেছিল, কিন্তু ছাড়াইবার জন্য কেহ অগ্রসর হইল না। বৃদ্ধের বাহুতে এমন শক্তি যে সে শ্যালকদ্বয় ও স্ত্রীকে প্রহার করিয়া, সরিয়া গিয়া বসিল। তাহারা তিনজন তিন রকম সুরে কাঁদিতে আরম্ভ করিল।

বিবেকানন্দ স্বামী ও আমি ডিঙ্গীতে করিয়া, পার হইয়া, যুদ্ধক্ষেত্রে উপনীত হইলাম। এক শ্যালকের পিঠে পাথর ফাটিয়া রক্ত বহিতেছে। বিবেকানন্দ স্বামী বৃদ্ধকে বলিলেন, "স্ত্রীলোকের গায়ে হাত তুলিস্, তুই এত বড় পাষণ্ড!” সস্ন্যাসীর ক্রোধ দেখিয়া সকলে ভীত হইল। আমি মাঝিকে দিয়া স্ত্রীলোকটিকে জিজ্ঞাসা করাইাম, কি হইয়াছে? সে তাড়াতাড়ি লোহার হাতুড়িটা তুলিয়া লইয়া বলিল,আমাকে এই হাতুড়ি দিয়া মারিয়াছে। কথাটা বাড়াইয়া বলিল, কিন্তু আমরা তাহা অবিশ্বাস না করিয়া তাহার স্বামীকে বলিলাম, “আয়, আমাদের নৌকায় আয়, তোকে পুলিসে দিব ।"

তৎক্ষণাং স্বামীর স্বীবিদ্বেষ অন্তর্হিত হইল! শ্যালারাও মিনতি করিতে লাগিল যেন অপরাধীকে ধরিয়া না লইয়া যাওয়া হয়। আমরা কোন কথা শুনি না দেখিয়া স্ত্রী নৌকার গিয়া একটি শিশুকে কোলে করিয়া আনিয়া স্বামীর কোলে দিল যেন জন্মের শোধ সে একবার স্ত্রী-পুত্রকে দেখিয়া লইবে! সকলের নিকট বিদায় লইয়া বুড়া আমাদের নৌকায় উঠিল। আমাদের যে কি ক্ষমতা তাহাকে লইয়া যাই, সে কথা কেহ একবার জিজ্ঞাস করিল না! এক জন সন্ন্যাসী আর একজন পরিব্রাজক, আমাদিগকে যদি মারিয়া খাকাইয়া দেয় ত কোন উপায় নাই, কিন্তু কেহই কোন কথা বলি্ল না, কেহ বৃদ্ধকে ছাড়াইয়া লইবারচেষ্টা করিল না। তাহাকে পারে লইয়া আসিয়া, খানিক বসাইয়া রাখিয়া, ধমক দিয়া আবার ছাড়িয়া দিলাম।

কোন্দলে ধামা চাপা দিবার একটা প্রবাদ আমাদের দেশে আছে; কাশ্মীরে তাহা নিত্য ঘটিয়া থাকে। দুইটা স্ত্রীলোক অনেকক্ষন ঝগড়া করিয়া,দুইটা ধামা আনিয়া উপুড় করিয়া রাখে। সে দিনের মত ঝগড়া ধামাচাপা রহিল। পর দিবস প্রভাতে দুই জনে লাখি মারিয়া, ধামা উলটাইয়া দিয়া, আবার ঝগড়া আরম্ভ করে। অপর সৌন্দর্যের সহিত কাশ্মীরের নামগুলিও সুন্দর। লোলাব, লিদর, প্রভৃতি উপত্যকার নাম, ভগ্নাবশিষ্ট মার্তন্ডমন্দির, বিতস্তার উৎপত্তি স্থান অনন্তনাগ, অমরনাথ, ক্ষীরভবানী, পামপুর, এ সকল নামেরও মোহিনী শক্তি আছে। এত সৌন্দর্য্য, এত গাম্ভীর্য আর কোন স্থানে একত্র দেখিতে পাওয়া যায় না।

                                          শ্রীনগেন্দ্রনাথ গুপ্ত।