পাতা:প্রবাসী (ষট্‌ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/২৩৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মানুষের মন শ্রীজীবনময় রায় (s) ফেনিসগঞ্জ একটা গ্রাম নয়। ইমারতের মধ্যে রঙ্গিণী নদীর উত্তর পারে একটা পুরাতন নীলকুঠি, আর তার চতুৰ্দ্দিকে প্রকাণ্ড একটা আমবাগান। তা আমবাগান কি সুন্দরবন এখন বোঝা শক্ত। এই অট্টালিকায় যাবার পথ ঐ বিরাট বনের মধ্যে একেবারে গা-ঢাকা দিয়েছে। দেউড়ির দরজার কতকটা অংশ নিজের বিপুল ভারে ভেঙে পড়েছে এবং চতুদ্ধিকে বনকুল, নোন, কাটাঝোপে জড়াজডি ক'রে নদী থেকে বাড়ি পৰ্য্যস্ত সমস্তটা একটা ভয়াবহ জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। বাড়ির পূর্ব দিকে প্রকাও প্রকাণ্ড নীলের হাউজ। তার ভিতরেও জঙ্গল গভীর । এতদিনকার, তবু কি আশ্চৰ্য গাথুনি এই হাউজের—একখানি ইটও তার খসে যায় নি। জায়গায় জায়গায় জঙ্গলের ফাক দিয়ে তার কতক অংশ চোখে পড়ে। চারি দিক এত নির্জন যে খানিক ক্ষণ অপেক্ষা করলে নিজেকে জীবলোকের বাসিন্দা বলে মনে হয় না। মাঝে মাঝে বিশালকায় রবার, মেহগনি, সেগুন, শিশু প্রভৃতি গাছে সে বনের চায় নিবিড়তর করে তুলেছে । নদীর ঘাটের কাছে একটা ছোট মোটর-লঞ্চ বাধা । সেই লঞ্চে বসে ইংরেজবেশধারী একটি বাঙালী ভদ্রলোক, একটি বৃদ্ধ বিধবা ও একটি স্বন্দরী কথাবাৰ্ত্ত বলছিলেন। বৃদ্ধ বলছেন, “তোর যেমন পছন্দ বাছ, এই বনাল জায়গায় কি মনিন্তি আসে। বাঘে থেয়ে ফেলবে যে ” বৃদ্ধ বড় মিথ্যে বলেন নি। শচীন্দ্র ও পাৰ্ব্বতী সকাল বেলা নদীর কিনারা তদারক করতে গিয়ে তার কিছু পরিচয় পেয়ে এসেছিল। নদীর পাড়ে কৃষ্ণচুড়ার গাছটা যেখানে জলের উপর কুয়ে পড়েছে, কোন কালে সেখানে হাউজ পৰ্য্যস্ত জলসরবরাহের জন্য একটা কাটা খাল ছিল। এখন তার অনেকটা বুজে এসেছে। বর্ষার দিন ছাড়া সে খালে এখন আর জলস্রোত প্রবেশ করে না। সেই খালের মুখে যে বাঘে জল খেতে আসে তার স্পষ্ট প্রমাণ কাদার উপর ছাপার অক্ষরে সে রেখে গেছে। পাৰ্ব্বতী দেখিয়ে বললে, “মিষ্টার সিংহ, দেখেছেন? এখানকার বাসিন্দা র্যার, আর বেশী দূর এগনো তারা ট্রেসপাস ব’লে গণ্য করবেন। শেষে কি মেচিওর করবার আগেই আপনার নারী-কল্যাণের অতবড় আইডিয়াটা বেঘোরে বাধের মুখে মারা পড়বে " শচীন বললে, “ভয় কি ? আমি একলা হ'লেও বা বাঘে সিংহে একটা বোঝাপড়া হ’তে পারত। কিন্তু একেবারে সিংহবাহিনীর সাক্ষাতে এতটা বেয়াদবী করতে বাবাজীর ভরসায় কুলোবে না ; কি বল ?” “ইস্ তাই বইকি ! একেবারে ল্যাজটি মুথে পূরে গরুড়পক্ষীটির মত হাতজোড় ক'রে এসে প্রথমে পদচুম্বন করবে এবং পরে বোধ হয় সবিনয়ে মুখচুম্বনের অনুমতি চাইবে ? যাই বলুন, আপনার চয়েসের তারিফ করতে হয়। কি চমৎকার জায়গাই বেছেছেন, ভেবেচিন্তে । বাঘের পেটে সব ক’টা মেয়েকে একসঙ্গে যদি ন-দিতে পারেন ত সাপের অভাব নেই বোধ হয়। তাও যদি পিতৃপুণ্যে কেউ রক্ষে পায় তো—” এই বলে সশব্দে একটা চাপড় মেরে “উ, সমস্ত হাত-পা একেবারে ফুলিয়ে দিয়েছে। বাব বা:, ম্যালেরিয়ায় নির্ঘাত বাংলার নারীনির্যাতনের সব প্রবলেম—” আবার চপেটাঘাত। “ইস্ তাই ত! কুইনিন থেয়েছিলে ত সকালে উঠে ? ঐটি ভুলে না কিন্তু। আর যাই বল, এমন চমৎকার লোকালয়ের অন্তরালে, নদীর ধারে এমন উপযুক্ত জায়গা আর কোথাও পাবে না-” “হঁ্য, এমন বড় বড় মশা, এমন শ্বাপদসঙ্কুল বিস্তৃত বনভূমি, এমন নিবিড় কাটাঝোপ,—” শচীন্দ্র হেসে বললে, “কঁাটাঝোপই ভোঁ ; সেই কণ্টক উদ্ধার করবার জন্যেই তো এই আয়োজন।"