পাতা:প্রবাসী (ষট্‌ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৩৭৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আষাঢ় মানুষের মন \డిప్రిన్స్ల এক্ষেত্রে মালতীর চিত্ত থেকে নির্বাসিত হয়ে তার নারীচিত্তের ভগবদত্ত স্বাভাবিক মহিমাকে যে ক্ষুণ্ণ করেছিল সে-বিষয়ে সন্দেহ নাই। তাই তার গৃহের মধ্যে, তার চক্ষের সমক্ষে, এমন কি তারই বিস্তৃত আয়োজনের সহায়তায় তারই নিজের দুনিবার দুঃখের কারণ এমন ক’রে ঘনিয়ে উঠবে তা সে স্বপ্নেও ভাবতে পারে নি। নন্দলালের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় যে কোথাও কিছুমাত্র শৈথিলা ঘটেছিল তা নয়, সে নিত্যনিয়মিত পূর্বের মতই সকালে খেয়েদেয়ে বেরিয়ে পড়ত এবং সমস্ত দিন নানা ধন্ধায় ঘুরে ক্লান্ত দেহে বাড়ী ফিরত । মালতী তাকে গিয়ে দরজা খুলে দিয়ে জিজ্ঞেস করত, “কি গে, কোন কিনার হ’ল ?” নন্দলাল সংক্ষেপে বলত, “না” । সন্ধানের উৎসাহ তার চিত্তে প্রবল নয়। তা ছাড়া এক্ষেত্রে সন্ধান যে কি উপায়ে সুরু করবে তা সে ভেবে উঠতেও পারে না । মালতী বলে, “কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দাও ন গ৷ ” নন্দ হেসে বলে, “মইলে মেয়ে-বুদ্ধি কেন বলবে! তাহলে ওর স্বামী বিজ্ঞাপন দিলে না কেন ? বড়ঘরের বেী, জানাজানি হ'লে আর ফেরবার পথ থাকবে ?” মালতী হতাশ হয়ে বলে, “ত যা হয় কর । বড় কান্নাকাটি করে যে !” তার পর খোকনের ডাক পড়ত এবং এই শিশুটিকে উপলক্ষ্য করে নন্দলাল তার হৃদয়ের বাস্পাবেগ কতকট। মুক্ত ক’রে দেবার স্থযোগ পেত। কখনও বা খোকনকে কোলে নিয়ে কমলার কাছে যেত এবং অত্যন্ত মামুলি দু-একটা কুশল প্রশ্ন করত । এই ত গেল তার দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস । বাইরের দিক দিয়ে দেখতে গেলে এ যেমন বৈচিত্র্যবিহীন তেমনই ক্লাস্তিকর । কিন্তু মামুষের মন ত বাইরের গণিতের হিসাবের খাজনা দিয়ে চলে না । সে তার অস্তনিহিত গোপনতম অবচ্ছন্ন মনের নিগুঢ় প্রেরণায় নিয়ন্ত্রিত হয়। নন্দলালের পুরুষ-চিত্ত কৰ্ম্মপ্রবাহের এই নিরবচ্ছিন্ন অনসবরের মধ্যে জীবনের একটি অনাস্বদিতপূৰ্ব্ব রসের সন্ধান তার অস্তরের মধ্যে পেয়েছিল। তার জীবন, তার কৰ্ম্মচেষ্টা তার কাছে অকস্মাৎ অধিক অর্থপূর্ণ, অধিক আবখ্যক বলে মনে হতে লাগল। কলেজে পড়ার সময় যে-সব বই তার কাছে নিতাস্ত পরীক্ষাপাসের যন্ত্রস্বরূপ বলে মনে হ’ত, এখন আবার ভারী তাদের নূতনতর কাব্যরূপ নিয়ে তার মনের মধ্যে এসে সাড় দিতে লাগল। আবার সে একটু একটু ক'রে পড়াশুনা আরম্ভ ক'রে দিলে। বৈষ্ণবপদাবলী এবং রবীন্দ্রনাথ সে নূতন ক’রে পড়তে মুরু করলে এবং মাঝে মাঝে মালতী ও কমলকে নিয়ে রাত্রে তার চিত্তের এই নূতন অনুভূতির আবেগে পড়ে শোনাতে চেষ্টা করতে লাগল । মালতী তাকে বললে, “কি গে, আবার এগ জামিন পাস দেবে না কি ?” নন্দলাল বললে, “দেখি না, মুখু হয়ে থেকে লাভ কি ?” মালতীর কিন্তু সমস্ত দিন খাটুনির পর এ-সব ভাল লাগে না। সে বরং একটু গল্পগাছা করতে চায় । পড়া শুনতে শুনতে হঠাৎ বলে, “ঐ যা, দুইটা পেতে রাখতে ভুলে গেছি।” কমল কোন কথা বলে না, চুপ করেই বসে থাকে। নন্দলালের কিন্তু উৎসাহের বিরাম নাই। সে উচ্চৈঃস্বরে আবৃত্তি ক’রে যায় "হৃদয় আজি মোর কেমনে গেল খুলি? জগৎ আসি সেখ! করিছে কোলাকুলি’ আর তার চিত্ত কবিতার স্বরে স্বরে নূতনতর পরিপূর্ণতর আনন্দময় জগতের মধ্যে সঞ্চরণ ক'রে ফেরে। মালতী অাচল পেতে মেজের উপর শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে ; কিংবা খানিক ক্ষণ পরে একটা কাজের নাম ক'রে উঠে পাশের ঘরে গিয়ে থোকাকে নিয়ে শুয়ে পড়ে। কমল দেয়ালে ঠেস দিয়ে জানালার অবকাশপথে খণ্ড আকাশের তারাময় নীরবতার দিকে চেয়ে বসে থাকে ; কি শোনে তা সে-ই জানে। তার মনের পটে তাঁর পূৰ্ব্বজীবনের ছবি ওঠে ভেসে । এমনি ক’রে আরও এক জন তাকে কবিতা গল্প উপন্যাস পড়ে শুনিয়েছে। কত মধুময় জাগরনিশীথ কেটেছে তাদের এই কাব্যচর্চায়; কত মধুরতর অবসানে রাত্রি প্রভাত হয়ে গেছে । সে যেন জাতিস্মর ; জন্মাস্তরের স্মৃতি বহন ক’রে তাকে বেঁচে থাকতে হয়েছে । গভীর রাত্রি পর্য্যস্ত পাঠ চলতে থাকে। দূরে রাস্তার