পাতা:প্রবাসী (ষট্‌ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৬৫১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ব্রতচারীর ব্রত শ্ৰীসরলা দেবী চৌধুরাণী রায়বেশে নৃত্যের লুথোদ্ধার করেছেন দত্ত-মশায়, এই প্রথমে জানি । তার পরে ব্রতচারী নামে কতকগুলি প্রাচীন নৃত্যপ্রচারপ্রধান একটা অনুষ্ঠান গড়ে উঠেছে, তা শুনি । তারও পরে শিক্ষক-সমিতির উৎসবে চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জন হয়, সেই নৃত্যগুলি দেখি । নাচের সঙ্গে সঙ্গে যে-গান হচ্ছিল দর থেকে তার কথাগুলো ভাল ধয়vত পারি নি, কিন্তু বঙালী যুবক ও প্রেটদের নৃত্যের ছাদে, আমোদের রসে মিশ্রিত সাবলীল ব্যয়ামভঙ্গিম দেখতে খুব ভাল লেগেছিল। বাঙালী সমাজে-কি উচ্চ কি নীচের স্তরে, লতা জিনিষটা একেবারে উঠে গিয়েছিল । ‘মৃত্য' কথাটা 'নেত’ শব্দে পরিণত হয়ে একটা হাসির, ঠাটার, বিদ্রুপের, তাচ্ছিল্যের, সুণার বঙ্গ হয়ে দাড়িয়েছিল । পূজনীয় রবীন্দ্রনাথ কয়েক বৎসর ধ’রে শিল্পজগতে নৃত্যকলাটির পুনরুদ্বোধনে নিবিষ্টচিত্ত হয়ে সার্থকতা লাভ করে আসছিলেন । উদয়শঙ্গর রঙ্গমঞ্চে নেমে সেট আরও ব্যাপ্ত করলেন। কিন্তু তখনও মৃত্যটি উচ্চ কলার ঘরে রইল, সাধারণের নিত্য ব্যবহারের বস্থ হ’ল ন । এই সময় এলেন গুরুসদয় দত্ত । এষ্ট মানুষটির ধাতে লোকহিতৈষণ ব’লে একটা জিনিষ নিহিত আছে। বাংলায় সিভিলিয়ান ত আরও কত বাঙালী হয়েছে। জেলায় জেলায় ম্যাঞ্জিষ্ট্রেটি ক'রে জেলার গণ্যমান্ত থেকে নগণ্য চাযাভূষ। সকলের সংস্পর্শে আসার সুযোগ কত জনের হয়েছে । কিন্তু সে সুযোগকে বরণ করে নেওয়া, নিয়ে সেটা তাদেরই উপকারে লাগান—এ রকম প্রবৃত্তি ক'টা লোকের দেখা যায় ? গীবিয়োগ হয় অনেক লোকের, কিন্তু সেই স্ত্রীবিয়োগজনিত শোকে দেশময় গীর্জাতির কল্যাণসাধক প্রতিষ্ঠান থোলে ও খোলায় কটা লোকে ? এই রামোপম স্বামীর জীবনে প্রকৃতপক্ষেই হয়েছে— সঙ্গে সৈব তথেক বিরহে তন্ময়ং ত্রিভুবলম্ ॥ একটা অফুরস্ত প্রাণের আবেগ এই লোকটির মধ্যে পাওয়া যায়। সেই প্রাণ প্রথমে তার নিকটতম প্রিয়তম আত্মীয়ের স্মৃতি অবলম্বন ক'রে আপনাকে ছড়ালে। তার পর সেই প্রাণ আরও ব্যাপকভূমি গ্ৰহণ করলে নিজের বিস্তৃতির জন্য। তাই রায়বেশে নৃত্যের আবিষ্কার শুধু নৃত্যপ্রচারেই তৃপ্ত থাকতে পারলে না। সেই নৃত্যকে কেন্দ্র করে, একটা বৃহৎ আদর্শকে জীবন্ত করে তুললে—সেটি বাঙালীকে মাতুয় ক’রে তোলা । রবীন্দ্রনাথ একদিন ক্ষোভভর হৃদয়ে বলেছিলেন-- মাতৃভূমিকে মান্ত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী, বেথেষ্ট বাঞ্চালী করে, মানুষ কর নি । আজ গুরুসদয় দত্ত কবির সেই ক্ষোভ মিটানর জন্যে বদ্ধপরিকর হলেন, তাই তার মৃত্যচর্চ একটা ব্রতর ছাচে পড়ে গেল। আর ‘রায়বেঁশে’, ‘রায়বেশে শোনা গেল না, ‘ব্রতচারী ব্রতচারী শোনা গেল । ‘ব্রতচারী-প্রগতির বাইরের শরীরট হচ্ছে কতকগুলি নৃত্য, কিন্তু তার ভিতরের আত্ম হচ্ছে কতকগুলি ব্রত। একটা ভাবের ক্ষ্যাপা, একটা ভাবের পাগল না জাগলে যে দেশের ধাত বদলাতে পারে না, দেশের মরা ও আধমরা যুব বুড়োকে, ছেলেমেয়েকে জাস্ত করে তুলতে পারে না, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই । এক অদৃশু গুরু যার প্রেরমিত, সেই গুরুসদয় তার প্রাণের আবেগে দ্বিধাসঙ্কোচ, বাধাবিপত্তি, লজ্জাসরম কিছু জানেন না, কিছু মালেন না । তিনি মানুষ-গড়ার গুরু, তাই বাণীর কমলবন ছিড়েছুড়ে যেগান থেকে দুটো কথা সংগ্রহ করা যায় তাই ক’রে তার কাজ উদ্ধাব করতে হবে । যখন ভদ্রলোকের ছেলের হাতে কোদাল ধরাতে হবে, তাদের দিয়ে কচুরিপানার অস্ত্যেষ্টিক্রিয়া সাধন করতে হবে, ব:পের অন্ন ধ্বংস করবে না, রোজগারের আগে বিয়ে করবে না প্রভৃতি নানা রকমের মনুমোচিত পুণ তাদের লওয়াতে হবে, তখন ছড়া-সাহিত্যের বেশী উদ্ধে উঠতে যাওয়ার চেষ্টা করা তার নিম্প্রয়োজন । পণগুলি বা ব্ৰতগুলি অস্থিমজ্ঞাগত ক’রে দেবার জন্যে জপের মত সে ছড়াগুলি বারস্বার আওড়ান বিশেষ ফলপ্রদ। আবার প্রত্যেক প্রতিজ্ঞাটা দেখছি স্যাকারে তার আরম্ভের অক্ষরের দ্বারা স্মৃতিতে গেথে দেওয়া হচ্ছে। অনেকের কাছে ছেলেপেলা হ'লেও আমরা ধারা মন্ত্রবাদী, একাক্ষর বীজমন্থে বিশ্বাসী --তার। এর মৰ্ম্মগ্রাহী। যেখানে যেখানে বাঙালী ছেলেমেয়ে ও শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রী, সেখানে সেখানে এই মন্ত্রগুলি নিত্য জপ ও নৈমিত্তিক অনুষ্ঠান যে দেশের মানসিক হাওয়া বদলে দেবে সে বিষয়ে সন্দেহমাত্র নেই।