পাতা:প্রবাসী (ষট্‌ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৮০৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

‘বিশেষ চিন্তিত আছি স্ত্রীরামপদ মুখোপাধ্যায় “প্রিয় নৃপেন, বহুদিন হইল তোমার কোন সংবাদ না পাইয়া বিশেষ চিন্তিত আছি।’ এইটুকু লিখিয়াই মহিম অতঃপর ভাবিতে বসিল। ভাবনার কিছু কারণ আছে বটে, কেন না, মহিমের বয়স মাত্র আঠার বছর ; ফাষ্ট ইয়ারের ছেলে—পাড়-গ হইতে সবে শহরে আসিয়াছে ভাল কলেজে পড়িতে। শহরের বৈচিত্র্য ও সমারোহ এই বয়সে মনকে প্রবল ভাবেই নাড়া দিয়া থাকে। কিন্তু প্রবাসী মহিমের মনে শহর এখনও বিশেষ ভাবে শিকড় গাড়িয় বসে নাই, কাজেই প্রবাস-বাসের দশ দিনের মধ্যে এমন একখানি পত্র লিখিবার প্রয়োজন হইয়াছে। পত্রের প্রথম ছত্র দেখিলেই মনে হয়, নৃপেন মহিমেরই স্বগ্রামবাসী, আবাল্য সহপাঠী। মহিমের সঙ্গেই ম্যাটিক দিয়াছে ; হয়ত পাস করিতে পারে নাই বলিয়া গ্রামে রহিয়া গিয়াছে অথবা পাস করিয়াও সামর্থ্যে কুলায় নাই তাই কলেজ-জীবন তাহার কাছে স্বপ্নের বিষয় হইয় রহিল ! ছেলেবেলা হইতে দু-জনের মধ্যে ভালবাসা আছে প্রচুর। চু-কপাটি খেলা শেষ করিয়া যখন নদীর ধারে বসিয়া (গ্রাম হইলে একটি নদীর কল্পনা স্বাভাবিক ) শ্রাস্ত ক্লাস্ত ছেলের দল গান গাহিয়া, বঁাশী বাজাইয়া, গল্প করিয়া সময় কাটাইয়া দিত, আসন্ন সন্ধ্যার তরল অন্ধকারে, দল হইতে একটু দূরে, জলের কিনারে শেষ পৈঠাটার উপর বসিয়া জলে পা ডুবাইয়। এই দুটি কিশোর তখন ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখিত। গ্রীষ্মের মধ্যাহ্নে আমবাগানে আলাপ বা বর্ষা-সন্ধ্যায় প্রদীপ জালিয়া চণ্ডীমণ্ডপের দাওয়ায় বসিয়া গল্প- দুটিতেই এক-মন আর এক-মনের অত্যন্ত নিকটবর্তী হয়। . কিন্তু মহিমের চিন্তার কারণ এ-সব কিছুই নহে। অত্যন্ত পরিচিত নৃপেনের কাছে চিঠি লিখিতে হইলে এক ছত্র লিখিয়া পরের ছত্রের জন্ত এত ভাবিতে হয় না। প্রবাসজীবনে দশ দিনে যে-সমস্ত বিস্ময় স্তুপীকৃত হইয়া উঠিয়াছে তাহার তলে রাশি রাশি ঘটনার সমাবেশ— লিখিতে বসিলে অনায়াসে লেখক-খ্যাতি অর্জন করা যায় । বয়স আঠার, সাহিত্যের স্বাদে মন অল্পবিস্তর মাতাল হইয় আছে, লিখিবার বিষয় পাইলে লেখনীর গতিকে ঠেকাইয়া রাখা যে কোন সাধনার চেয়ে কম আয়াসসাধ্য নহে ! কিন্তু এক ছত্র লিথিয়াই মহিম চিন্তিত হইয়া পড়িয়াছে। কোথা হইতে মুরু করিবে ও কোন কোন বিশেষণ প্রয়োগে ভাষাকে বলিষ্ঠ ও স্ব করা যায়, কতটুকু বলা চলে, ইঙ্গিতে বা কতটুকু কৌতুহলের স্বষ্টি করা যায় ; অস্পষ্ট ভাবের সঙ্গে অনস্ত পরিকল্পনার একটা বিরাটু আভাস—লিপিরচনার এই সমস্ত কলা-কৌশলই কি মহিমের ভাবনার বিষয় ? শহরে আসিয়া জগতের চিন্তাধারার স্বতাটি সে আবিষ্কার করিয়াছে, প্রবাসজীবনে প্রিয়বিরহব্যথার সঙ্গে বিভূতির সন্ধান সে পাইয়াছে ; বহু বিচিত্র রাগিণী মনের তারে লাগিয়া রহিয়াছে—কাহার দক্ষ অঙ্গুলির স্পর্শ পাইবামাত্র স্বরের কায় পরিগ্রহ করবে। সে অজানার ম্পর্শে মন ব্যাকুল, কিন্তু সে অজানাকে ভাষার মধ্যে আকার দেওয়া অসম্ভব। মহিমের কাছে নৃপেন অনেকটা সেইরূপ ; পরিচিত অথচ অজানা। এগারো দিন আগে নুপেন বলিয়া কোন যুবকের অস্তিত্ব তাহার কাছে ছিল না, অথচ এগারো দিন পরে লিখিতে হইতেছে, ‘বহুদিন তোমার কোন সংবাদ না পাইয়া বিশেষ চিন্তিত আছি।’ পত্রের পাঠ লিখিতে হইলে অথবা ভদ্রতার খাতিরে এগারো দিনকে বহুদিন বলিলে মিথ্যা ভাষণের অপরাধ হয় না, যদিও নৃপেনের আদর্শনে এ-কয় দিন বিশেষ চিন্তার কারণ তাহার হয় নাই ! এ-কয় দিনে সে বিশেষ ভাবে চিন্তা করিয়াছে বাড়ীর কথা অর্থাৎ গ্রামের কথা । সকালে বই খুলিয়া বসিলেই মনে পড়ে, রৌদ্রের তীব্র রেখা