পাতা:প্রবাসী (ষট্‌ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৮৬২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Ե-ՊՏ, আমরা তিন জন-আমি, ভিক্ষু অভিরাম ও এক জন ভুটিয়া পথপ্রদর্শক-গ্রামের নিকটবৰ্ত্তী হইতেই গ্রামের সমস্ত স্ত্রীপুরুষ বালক-বালিকা আসিয়া আমাদের ঘিরিয়া দাড়াইল । বহিজগতের মানুষ এখানে কখনও আসে না ; ইহারা স্ববর্ভূল চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া আমাদের নিরীক্ষণ করিতে লাগিল। চেহারা দেখিয়া মনে হইল ইহার লেপচা কিংবা ভূটানী । আধ্য রক্তের সংমিশ্রণও সামান্ত আছে ; দুই-একটা খড়েগর মত তীক্ষু নাক চোখে পড়িল । এইরূপ খড়গ-নাসিকা এক জন প্রৌঢ়গোছের লোক আমাদের দিকে অগ্রসর হইয়া আসিয়া নিজ ভাষায় কি বলিল। বুঝিতে পারিলাম না। আমাদের ভূটানী সহচর বুঝাইয়৷ দিল, ইনি গ্রামের মোড়ল, আমরা কি জন্য আসিয়াছি জানিতে চাহেন। আমরা সরলভাবে আমাদের উদ্দেশ্ব ব্যক্ত করিলাম। শুনিয়া লোকটির চোখে মুখে প্রথমে বিস্ময়, তার পর প্রবল কৌতুহল ফুটিয়া উঠিল। সে আমাদের আহবান করিয়া গ্রামে লইয়া চলিল । মিছিল করিয়া আমরা অগ্রসর হইলাম। অগ্ৰে মোড়ল, তাহার পিছনে আমরা তিন জন ও সৰ্ব্বশেষে গ্রামের আবালবৃদ্ধ নরনারী। একটি কুটীরের মধ্যে লইয়া গিয়া মোড়ল আমাদের বসাইল, আমরা ক্লাস্ত ও ক্ষুৎপীড়িত দেখিয়া আহার্ষ্য দ্রব্য আনিয়া অতিথিসৎকার করিল। অতঃপর তৃপ্ত ও বিশ্রাস্ত হইয়া আমরা দোভাষী ভূটিয়া মারফৎ বাক্যালাপ আরম্ভ করিলাম। সুৰ্য্য তখন পাহাড়ের আড়ালে ঢাকা পড়িয়াছে ; হিমালয়ের সুদীর্ঘ সন্ধ্যা যেন স্বচ্ছ বাতাসে অলক্ষিত কুঙ্কুমবৃষ্টি আরম্ভ করিয়াছে। মোড়ল বলিল—গ্রাম হইতে চার ক্রোশ উত্তরে উপল৷ নদীর প্রপ্রাত—ঐ প্রপাত হইতেই নদী আরম্ভ। ঐ স্থান অতিশয় দুর্গম ও দুরারোহ ; উপলার অপর পারে প্রপাতের ঠিক মুখের উপর একটি স্তম্ভের মত পৰ্ব্বতশৃঙ্গ আছে, উহাই বুদ্ধস্তম্ভ নামে খ্যাত। গ্রামবাসীরা প্রতি পূর্ণিমার রাত্রে বুদ্ধ-স্তম্ভকে উদ্বেশ করিয়া পূজা দিয়া থাকে। কিন্তু সে স্থান দুরধিগম্য বলিয়া সেখানে কেহ যায় না, গ্রামের নিকটে উপল নদীর স্রোতে পূজা ভাসাইয়া দেয়। প্রবাসী $N9BNలి ভিক্ষু জিজ্ঞাসা করিলেন, উপলা পার হইয়া স্তম্ভের নিকটবর্তী হইবার পথ কোথায় ? মোড়ল মাথা নাড়িয়া জানাইল, পথ আছে বটে, কিন্তু তাহা এত বিপজ্জনক যে সে-পথে কেহ পার হইতে সাহস করে না। উপলার প্রপাতের নীচেষ্ট একটি প্রাচীন লৌহ শৃঙ্খলের ঝোলা বা দোদুল্যমান সেতু দুই তীরকে সংযুক্ত করিয়া রাখিয়াছে, কিন্তু তাহ কালক্রমে এত জীর্ণ হইয়া পড়িয়াছে যে তাহার উপর দিয়া মানুষ যাইতে পারে না। অথচ উহাই একমাত্র পথ । আমাদের গন্তব্যস্থানে যে পৌঁছিয়াছি তাহাতে সন্দেহ ছিল না। তবু নি:সংশয় হইবার অভিপ্রায়ে মোড়লকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ওই স্তম্ভে কি আছে তাহ কেহ বলিতে পারে কি না । মোড়ল বলিল—কি আছে তাহা কেহ চোখে দেখে নাই, কিন্তু স্মরণাতীত কাল হইতে একট প্রবাদ চলিয়া আসিতেছে যে বুদ্ধদেব স্বয়ং সশরীরে এই স্তম্ভে অবস্থান করিতেছেন, তাহার দেহ হইতে নিরস্তর চন্দনের গন্ধ নির্গত হয় ;–পাচ হাজার বৎসর পরে আবার মৈত্রেয়-রূপ ধারণ করিয়া তিনি এই স্থান হইতে বাহির হইবেন। ভিক্ষু আমার পানে প্রোজ্জ্বল চক্ষে চাহিয়া বলিয়া উঠিলেন, ‘বুদ্ধদেব সশরীরে এই স্তম্ভে আছেন, তার দেহ থেকে চন্দনের গন্ধ নির্গত হয়—প্রবাদের মানে বুঝতে পারছেন, যে-শ্রমণরা বুদ্ধমূৰ্ত্তি এনেছিল, তারা সম্ভবতঃ ফিরে যেতে পারে নি—এই গ্রামেই হয়ত থেকে গিয়েছিল—” ভিক্ষুর কথা শেষ হইতে পারিল না । এই সময় আমাদের কুটীর হঠাৎ একটা প্রবল ঝাকানি খাইয়। মড়-মড়, করিয়া উঠিল । আমরা মেঝের উপর বসিয়া ছিলাম, আমাদের নিম্নে মাটির ভিতর দিয়াও একটা কম্পন শিহরিয়া উঠিল । আমিও ধড়মড় করিয়া উঠিয়া দাড়াইলাম—“ভূমিকম্প ? আমরা উঠিয়া দাড়াইতে দাড়াইতে ভূমিকম্পের স্পন্দন থামিয়া গিয়াছিল । মোড়ল নিশ্চিন্তমনে মেঝেয় বসিয়া ছিল, আমাদের ত্রাস দেখিয়া সে মৃদুহাস্তে জানাইল যে ভয়ের কোন কারণ নাই ; এরূপ ভূমিকম্প এখানে প্রত্যহ চার-পাচ বার হইয়া থাকে, এ দেশের নামই ভূমিকম্পের জন্মভূমি । আমরা অবাক হইয় তাহার মুখের দিকে তাকাইয় রছিলাম। ভূমিকম্পের জন্মভূমি ! এমন কথাত কখনও শুনি নাই –তখনও জানিতাম না কি ভীষণ দুর্গান্ত সন্তান, প্রসব করিবার জন্য সে উদ্যত হইয়া আছে।