পাতা:প্রবাসী (ষট্‌ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৮৬৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।



পাল-সাম্রাজ্যের শাসন-প্রণালী

ডক্টর শ্রীরাধাগোবিন্দ বসাক, এম-এ, পিএইচ-ডি

পাল-বংশের প্রথম নরপাল গোপালদেব প্রকৃতিপুঞ্জকে মাৎস্য-ন্যায় বা অরাজকতার সর্ব্বনাশকারী উপদ্রব হইতে রক্ষা করিবার সামর্থ্য ধারণ করিতেন বলিয়া তাহাদের দ্বারা রাজপদে নির্ব্বাচিত হইয়া সমগ্র উত্তরাপথের পূর্ব্বাঞ্চলে অষ্টম শতাব্দীর প্রথমার্দ্ধে সাম্রাজ্য-প্রতিষ্ঠার ভিত্তিপত্তন করিতে পারিয়াছিলেন। এই সাম্রাজ্য অপ্রতিহতভাবে অনেক বৎসর চলিতে থাকিয়া মধ্যে মধ্যে ভাগ্যপরিবর্ত্তন দর্শন করিয়াছিল। পুনরায় ইহা পূর্ব্ব-সমৃদ্ধি লাভ করিয়া প্রায় দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথম পাদ পর্য্যন্ত একরূপ অক্ষুণ্ণ রহিয়াছিল। এই পাল-বংশের রাজত্ব-সময়ে নরপালেরা কিরূপ প্রণালী অবলম্বন করিয়া রাজ্যশাসন করিতেন, তাঁহাদের এ-যাবৎ আবিষ্কৃত তাম্রশাসন হইতে সংগৃহীত উপাদান অবলম্বন করিয়াই আমি তাহা বুঝাইতে চেষ্টা করিব। অতি সংক্ষেপে এই স্থানেই পাল-রাজগণের পৌর্ব্বাপর্য্য একটু জানিয়া লওয়া উচিত। পাল-সাম্রাজ্যের যুগকে নিম্নলিখিত ভাবে বিভক্ত মনে করা যাইতে পারে। এই বংশের প্রথম রাজা প্রথম-গোপাল, তংপুত্র প্রবলপরাক্রান্ত ধর্ম্মপাল ও তৎপুত্র দেবপাল ও তৎপুত্র প্রথম-বিগ্রহপাল এবং তাঁহার পুত্র নারায়ণপাল—এই পঞ্চ ভূপালের যুগকে এই সাম্রাজ্যের প্রথম সমৃদ্ধির যুগ বলিয়া ধরা যাইতে পারে। তৎপর নারায়ণপালের পুত্র রাজ্যপাল, তৎপুত্র দ্বিতীয়-গোপাল ও তংপুত্র দ্বিতীয়-বিগ্রহপালের যুগকে একটি বিপ্লবের যুগ বলিয়া মনে করা যায়—কারণ, এই সময়েই অনধিকারী কাম্বোজ-বংশীয় কোন নরপতি পাল-রাজগণের রাজ্য আক্রমণ করিয়া গৌড়দেশে অনেক অনর্থ উৎপাদন করেন। ইহার পরযুগেই দ্বিতীয়-বিগ্রহপালের উপযুক্ত পুত্র ইতিহাস-বিখ্যাত প্রথম-মহীপাল পৈতৃক রাজ্যের পুনরুদ্ধার সাধন করিয়া তৎপুত্র নয়পাল ও তৎপুত্র তৃতীয়-বিগ্রহপাল-দেবকে রাজত্বসুখরূপ ফল ভোগ করিবার পথ পরিষ্কার করিয়া দেন। তার পরে যে-যুগ উপস্থিত হয় তাহা বৈদেশিক কোন বংশ বা রাজার উৎপাত হইতে সম্ভূত বিপ্লবের যুগ নহে, কিন্তু তৃতীয়-বিগ্রহপালের জ্যেষ্ঠপুত্র দ্বিতীয়-মহীপাল অনীতিপরায়ণ হইয়া রাজ্যশাসন করিতে আরম্ভ করিলে পর, গৌড়ের প্রজাপুঞ্জ লোকনায়ক কৈবর্ত্তপতি দিব্য বা দিব্বোকের অধিনায়কত্বে বিদ্রোহী হইয়া মহীপালকে বধ করিয়াছিলেন, এই নিমিত্ত ইহাকে প্রজাবিদ্রোহের যুগ বলা যাইতে পারে। একাদশ শতাব্দীর এই সময়ে পুনরায় বরেন্দ্রীমণ্ডলে মাৎস্য-ন্যায় প্রবর্ত্তিত হইতে দেখা গেল। এই বিদ্রোহের সময়ে অত্যাচারী রাজা দ্বিতীয়-মহীপাল তদীয় উপযুক্ত কনিষ্ঠ ভ্রাতা শূরপাল ও রামপালকে কারারুদ্ধ করিয়া রাথিয়াছিলেন। ক্রমে রামপাল কোনও প্রকারে কারামুক্ত হইয়া বিশাল গৌড়রাজ্যের নানা প্রদেশ হইতে সামন্তচক্র সম্মিলিত করিয়া প্রথমতঃ দিব্যের অধিকৃত, পরে তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা রূদোকের পুত্র রাজা ভীমের দ্বারা কিয়ৎকালের জন্য শাসিত, রাজ্য পুনরায় স্বহস্তগত করেন। ‘জনকভূ’ বরেন্দ্রীর পুনরুদ্ধার সাধন করিতে গিয়া রামপালকে যে কিরূপ ক্লেশ-স্বীকার ও কৌশল অবলম্বন করিতে হইয়াছিল তাহা, যাঁহারা সন্ধ্যাকর-নন্দীর ‘রামচরিত’ পাঠ করিবার সুযোগ পাইয়াছেন, তাঁহারাই অবগত আছেন। প্রকৃতিপুঞ্জের নির্ব্বাচনে যে রাজবংশের প্রথম প্রতিষ্ঠা হইয়াছিল—এবং এখন আবার প্রজাপুঞ্জের অসন্তোষে যাহার ভিত্তিকম্পন উপস্থিত হইল, সেই বংশের ভবিষ্যৎ আর বড় উজ্জ্বল থাকিতে পারে নাই। তথাপি পরবর্ত্তী বা শেষ যুগের তিন নরপতি, অর্থাং রামপালের উপযুক্ত পুত্র কুমারপাল ও তৎপুত্র শিশু-নরপতি তৃতীয়-গোপাল ও রামপালের কনিষ্ঠ পুত্র মদনপাল সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধি পুনরায় বাড়াইয়া লইতে পারিলেও, মোটের উপর এই সপ্তদশ পাল-নরপালের রাজ্যভোগের পরেই পাল-সাম্রাজ্যের অধঃপতনের যুগ আপতিত হইয়াছিল। কি প্রকারে তাঁহাদের শাসন-শৃঙ্খলা ছিঁড়িয়া গেল তাহা এই প্রবন্ধের প্রতিপাদ্য নহে।