পাতা:প্রবাসী (ষট্‌ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৮৭০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৮৮৪
প্রবাসী
১৩৪৩

তাহা এখানে বলা সম্ভব নহে। সুতরাং আমি এখন শাসনকার্য্যের বিভিন্নতা অনুসরণ করিয়া পাল-সাম্রাজ্যের ভিন্ন ভিন্ন রাজপাদোপজীবিগণের নাম ও তাহাদের রাজ্যশাসনকার্য্যে করণীয় সম্বন্ধে কিছু কিছু নিবেদন করিতে ইচ্ছা করি। কর বা রাজস্ব বিভাগ, সৈন্য বিভাগ, পুলিস ও দেওয়ানী বিভাগ ও সঙ্কীর্ণ বিভাগেই আমরা পাল-রাজগণের তাম্রশাসনাদি হইতে প্রাপ্ত রাজপাদোপজীবীদিগকে সম্প্রতি অন্তর্ভুক্ত করিয়া তাহাদের কার্য্য বা ব্যাপার বর্ণনা করিব।

 গুপ্ত-সাম্রাজ্যের ন্যায় পাল-সাম্রাজ্যের জনপদসমূহ শাসন-সৌকর্য্যার্থে নানা প্রকার বিভাগে বিভক্ত ছিল। রাজ্যের বড় বিভাগের নাম ছিল ‘ভুক্তি’—যথা, শ্রীনগরভুক্তি, তীরভুক্তি, পুণ্ড্রবর্দ্ধনভুক্তি ইত্যাদি। একটা ভুক্তিতে অনেকগুলি ‘মণ্ডল’ থাকিত, যথা ব্যাঘ্রতটীমণ্ডল, গোকলিকা, আম্রষণ্ডিকা, হলাবর্ত্ত প্রভৃতি। একটি মণ্ডলে অনেকগুলি ‘বিষয়’ (বা district) অন্তর্ভুক্ত থাকিত, যথা কোটিবর্ষ, মহান্তাপ্রকাশ, স্থালীক্কট, ক্রিমিলাবিষয়, কক্ষবিষয় ইত্যাদি। আবার একটি বিষয়ে বহু ‘গ্রাম’ সন্নিবিষ্ট থাকিত। সুতরাং দেখা যাইতেছে যে ভুক্তি, মণ্ডল, বিষয় ও গ্রাম—এই সংজ্ঞাগুলি পাল-যুগের জনপদাংশবাচী। গুপ্ত-যুগে ভুক্তিপতিগণ সম্রাট্ কর্ত্তৃক রাজধানী হইতে নিযুক্ত হইয়া শাসকরূপে তৎ-তৎ ভুক্তিতে গিয়া রাজ্যশাসন করিতেন। তাঁহাদের উপাধি থাকিত ‘উপরিক-মহারাজ’। তাঁহারা আবার ‘কুমারামাত্য’-উপাধিসমন্বিত বিষয়পতিদিগকে নিযুক্ত করিতে পারিতেন। দেবপালদেবের সময়ে ব্যাঘ্রতটীমণ্ডলের অধিপতি ছিলেন রাজার দক্ষিণভুজরূপী শ্রীবলবর্ম্মা। তিনিই নালন্দা তাম্রশাসন-সম্পাদন সময়ে দূত্যবিধান বা দূতকের কাজ করিয়াছিলেন।

কর বা রাজস্ব বিভাগ

 ভোগপতি—যাহার নাম ভোগপতি তিনি কি ভুক্তিপতি? তাহা হইলে তিনি বিষয়পতি হইতে অধিকতর উচ্চস্থ রাজকর্ম্মচারী—আর যদি তিনি ‘ভোগ’-নাম রাজাদের করবিশেষের সংগ্রহকারী হইয়া থাকেন, তাহা হইলে তিনি রাজস্ব-বিভাগের কর্ম্মচারী। অর্থশাস্ত্রের গণিকাধ্যক্ষপ্রচারেও ‘ভোগ’ শব্দের প্রয়োগ দেখা যায়—গণিকাদের অর্জ্জিত অর্থের নাম ‘ভোগ’—যিনি ‘ভোগ-কর’ সংগ্রহকারী তিনিই কি ভোগপতি?

 বিষয়পতি—ভুক্তিপতি ও মণ্ডলপতির নীচের কর্ম্মচারী হইলেন বিষয়পতি। তিনি এখনকার দিনের জেলা-ম্যাজিষ্ট্রেটের সঙ্গে কতকাংশে তুলিত হওয়ার যোগ্য। গুপ্ত-যুগে বিষয়পতিগণের নিজ নিজ অধিষ্ঠান (head-quarters town) থাকিত ইহা জানা গিয়াছে। তাহার নাম হইত বিষয়াধিকরণাধিষ্ঠান। তখন তাঁহারা নগরশ্রেষ্ঠী, প্রথম-সার্থবাহ, প্রথম-কুলিক ও প্রথম-কায়স্থ—এই চারি জন তৎ তৎ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি লইয়া রচিত বিষয়-শাসন পরিষদের সাহায্যে বিষয় শাসন করিতেন। মনে হয়, পরবর্ত্তীকালে পাল-রাজগণের শাসন-সময়েও সেই প্রকার শাসনপদ্ধতি প্রচলিত রহিয়াছিল।

 গ্রামপতি—গ্রামপতি, ‘গ্রামপ’ বা ‘গ্রামনেতা’ নামেও পরিচিত ছিলেন। তিনি বিষয়পতির তত্ত্বাবধানে থাকিয়া কার্য্য করিতেন। প্রজারা যাহাতে দস্যুচৌরাদি ও রাজার অন্যান্য অধিকারিবর্গের অত্যাচার হইতে রক্ষা লাভ করে তৎপ্রতি লক্ষ্য রাখাই তাঁহার প্রধান কার্য্য ছিল। শুক্রাচার্য্যের মতে প্রত্যেক গ্রামে ‘সাহসাধিপতি’, ‘ভাগহার’, ‘লেখক’, ‘শুল্কগ্রাহ’ ও ‘প্রতিহার’—এই পাঁচ প্রকার রাজকর্ম্মচারী গ্রামপতির অধীন থাকিয়া রাজকার্য্য সম্পাদন করিতেন।

 দাশগ্রামিক—কৌটিল্যের মতে শাসনের সুবিধার জন্য অষ্ট শত গ্রামের মধ্যে যে (district townএর মত) নগর সংস্থাপিত ছিল তাহার নাম ছিল ‘স্থানীয়’। চারি শত গ্রামের মধ্যে (sub-divisional townএর মত) যে ছোট নগর সংস্থাপিত হইত, তাহার নাম ছিল ‘দ্রোণমুখ’, দুই শত গ্রামের মধ্যে (থানা-সদৃশ) ছোট স্থানের নাম ছিল ‘কার্বটিক’ বা ‘খার্ব্বটিক’ এবং দশ গ্রামের সমষ্টি দ্বারা গ্রামের যে স্থানকে লক্ষিত করা হইত, তাহার নাম ছিল ‘সংগ্রহণ’। মনে হয় এই ‘দশগ্রামী’র উপর যিনি শাসনকার্য্য পরিচালন করিতেন তিনিই ‘দাশগ্রামিক’ বলিয়া অভিহিত। মনুসংহিতাতেও ‘গ্রামাধিপতি’, ‘দশগ্রামপতি’, ‘বিংশতিশ’, ‘শতেশ’ ও ‘সহস্রপতি’ নামে পরিচিত, যথাক্রমে এক, দশ, বিংশতি, শত ও সহস্র সংখ্যক গ্রামের অধিপগণের নাম ও ব্যাপার বর্ণিত আছে। গ্রামপতি প্রতিদিন গ্রামবাসিগণ হইতে রাজার প্রাপ্য অন্ন, পান ও ইন্ধনাদি স্ববৃত্তির জন্য নিজে ভোগ করিতে পাইতেন।

 ষষ্ঠাধিকৃত—যাঁহারা রাজপ্রাপ্য ধান্যাদির ষষ্ঠ ভাগের আহরণ বা আদায় করিতেন সেই ‘ভাগহার’দিগের নায়ক যিনি, তিনি যষ্ঠাধিকৃত পুরুষ।