পাতা:প্রবাসী (ষট্‌ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৮৭২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৮৮৬
প্রবাসী
১৩৪৩

প্রাচীন কালে এই কর্ম্মচারীও অষ্টাদশ মহামাত্র বা তীর্থের অন্যতম বলিয়া গৃহীত হইত। তাঁহার করণীয়ের মধ্যে প্রধান এক কার্য্য এই ছিল যে, প্রান্তপ্রদেশ পার হইয়া সার্থবাহগণ যে যে দ্রব্য বাণিজ্যার্থ রাজার দেশে লইয়া আসিত তজ্জন্য ‘বর্ত্তনী’ নামক শুল্ক গ্রহণ করিয়া তাহাদিগের মালপত্রে অভিজ্ঞান বা চিহ্ন (স্বহস্তলেখ) ও মালের মুদ্রা বা পাস দিয়া শুল্কাধ্যক্ষ বা শৌল্কিকের নিকট পাঠাইয়া দেওয়া। শত্রুদিগের কার্য্যাবলীর সংবাদ গুপ্তচর দ্বারা সংগ্রহ করাও তদীয় অন্য কর্ত্তব্য ছিল।

 কোট্টপাল—যিনি কোট্টপাল নামে অভিহিত, তিনি পূর্ব্বে দুর্গপাল নামেও পরিজ্ঞাত ছিলেন। কি প্রকারে দুর্গনিবেশ ও দুর্গরক্ষা প্রভৃতি কার্য্য করিতে হয় তদ্বিষয়ে তিনি অভিজ্ঞ।

 গৌল্মিক—‘গুল্ম’ নামক পুলিস আউটপোষ্টের রক্ষিবর্গের প্রধান কর্ম্মচারী। মহাভারতে উক্ত আছে (শান্তিপর্ব্ব ৬৯ অধ্যায়ের ৭।৮ শ্লোকে) রাজাকে দুর্গে, সীমান্তে, নগরোপবনে, পুরোদ্যানে, কোষ্ঠপালদির উপবেশস্থানে, এবং রাজনিবেশনে ‘গুল্ম’ নিবেশ করিতে হইবে। কিন্তু অমরকোষের মতে ৯টি হস্তী, ৯টি রথ, ২৭টি অশ্ব ও ৪৫টি পদাতি লইয়া একটি ‘গুল্ম’ সংগঠিত হয়। তবে কি তিনি এই প্রকার সেনামণ্ডলীর অধিনায়ক?

 বলাধ্যক্ষ—বলাধ্যক্ষ সম্ভবতঃ কৌটিল্যের ‘পত্তধক্ষে’র পর্য্যায়ভুক্ত শব্দ। সেনা-বিভাগের যে প্রধান কর্ম্মচারীকে মৌল, ভূত, শ্রেণী, মিত্র, অমিত্র ও আটবিক—এই ছয় প্রকার বল বা সৈন্যের উপর কর্ত্তৃত্ব করিতে হইত, তিনিই বলাধ্যক্ষ।

 মহাসান্ধিবিগ্রহিক বা মহাসন্ধিবিগ্রহিক—ষাড়্‌গুণ্যবিৎ যে প্রধান অমাত্য কোন্ রাজার সহিত সন্ধি এবং কোন্ রাজার সহিত বিগ্রহ বা যুদ্ধ করিতে হইবে বিশেষতঃ এই ব্যাপারে অধিকৃত থাকিয়া রাজাকে সর্ব্বদা উপদেশ প্রদান করেন এবং প্রয়োজনবোধে রাজার আদেশে যুদ্ধাদি ঘোষণা করেন তিনিই এই আখ্যাধারী রাজপুরুষ। হর্ষবর্দ্ধনের অবন্তি নামক অমাত্যই সন্ধিবিগ্রহাধিকৃত ছিলেন বলিয়া আমরা হর্ষচরিতে (ষষ্ঠ উচ্ছ্বাসে) উল্লিখিত দেখিতে পাই। পালবংশের সপ্তদশ নরপাল মদনপালদেবের সন্ধিবিগ্রহিকের নাম ছিল ভীমদেব। সন্ধ্যাকর নন্দীর পিতা প্রজাপতি নন্দীও পাল-রাজের এক জন সন্ধিবিগ্রহিক ছিলেন বলিয়া ‘রামচরিতে’ আভাস পাওয়া যায়।

 নাবাধ্যক্ষ—“নৌসাধনোদ্যত” বাঙালীদিগের রাজ্যশাসনে নাবাধ্যক্ষ বা ‘নৌবল-ব্যাপৃতক’ কর্ম্মচারী থাকিবে ইহা আশ্চর্য্যের বিষয় নহে। পাল-রাজগণের জয়স্কন্ধাবারে হস্তী, অশ্ব, পদাতির ন্যায় নৌবল বা নৌবাট (নৌবাহিনী) শব্দ ব্যবহৃত দেখিতে পাওয়া যায়। মুসলমান আমলে এই নৌবাটই ‘নওয়ারা’ নামে পরিচিত ছিল। যে রাজকর্ম্মচারী নৌসেনার ঊর্দ্ধতম কর্ম্মচারী, তিনিই ‘নৌবল-ব্যাপৃতক’। কমৌলি লিপিতে পালশাসন-যুগের এক নৌযুদ্ধের বর্ণনা পাওয়া যায়। সুবর্ণভূমি ও যবদ্বীপ প্রভৃতিতে অবস্থিত রাজ্যের সহিত গৌড়রাজ্যের রাজকর্ম্মচারীদিগের যে নৌ-যোগে যাতায়াতের ব্যবস্থা ছিল, তাহা দেবপালদেবের নালন্দা-লিপি হইতে বেশ বুঝা যায়। কিন্তু যিনি ‘নাবাধ্যক্ষ’ বলিয়া পরিচিত তাঁহার করণীয়সমূহের মধ্যে প্রধান কার্য্য ছিল এই যে, তিনি সমুদ্রযায়ী নৌসমূহের যাতায়াত এবং নদীমুখে ও নদীর অন্যান্য তরণ স্থানে বণিকেরা রাজাদেয় শুল্কাদি দেয় কি না, সেই কার্য্যের অবেক্ষণ করা।

 তরপতি বা তরিক—রাজার নৌকা বিভাগ হইতে সাধারণে নৌকাভাড়া লইয়া কার্য্য করিতে পারিতেন। আমার মনে হয় ‘তরপতি’ বা ‘তরিক’ বলিয়া যাহাদের আখ্যা ছিল, তাহার নাবাধ্যক্ষের নিম্নতম কর্ম্মচারী—তাহারা নদীপ্রভৃতির তরণস্থানে তর-শুল্ক (ferry) সম্বন্ধীয় কার্য্যে ব্যাপৃত থাকিতেন। প্রাচীনকালে পোর্ট কমিশনারদিগের কর্ত্তার ন্যায় ‘পত্তনাধ্যক্ষ’-নামে এক রাজকর্ম্মচারী ছিলেন বলিয়া জান। গিয়াছে।

 হস্তিব্যাপৃতক—প্রাচীন ভারতে রাজার সৈন্য-বিভাগে হস্তীর ব্যবহার বড় আদরণীয় ও প্রয়োজনীয় ছিল। ভারতবর্ষে সর্ব্বত্রই হস্তিযুদ্ধের প্রবর্ত্তন বেশী ছিল। রাজাদিগের বিজয় নির্ভর করিত হস্তিসেনার উপর। [“জয়ো ধ্রুবং নাগবতাং বলানাম্”—কামন্দকীয়] কামন্দক এমনও বলিয়াছেন যে “গজেষু নীলাভ্রসম-প্রভেষু রাজ্যং নিবদ্ধং পৃথিবী-পতীনাম্”—কাল হাতীর উপর নরপতিগণের রাজ্যস্থিতি নির্ভর করে। সংক্ষেপে এই বলা যায় যে, ‘হস্তিব্যাপৃতক’ বা ‘হস্ত্যধ্যক্ষকে’ রাজার হস্তিশালার সর্ব্বপ্রকার কার্য্যের অবেক্ষণ করিতে হইত। হস্তীবলরক্ষার ব্যবস্থা তদীয় প্রধান কার্য্য। রাজার হস্তিশালাতে অবস্থিত হস্তীর জন্য ‘বিধা’ বা আহার, শয়ন, খাদ্যশস্যাদির প্রমাণ, কার্য্যে নিয়োগ, বন্ধনের উপকরণ এবং বর্ম্মাদি সাংগ্রামিক অলঙ্কারাদির ব্যবস্থা সম্বন্ধেও অবেক্ষণ তদীয় করণীয়ের মধ্যে ছিল। হর্ষচরিতে পাঠ করা যায় যে স্কন্দগুপ্ত নামক রাজপুরুষ হর্ষের অশেষ গজ-সাধনাধিকৃত ছিলেন।

 অশ্বব্যাপৃতক—এই কর্ম্মচারীর অন্য নাম ছিল অশ্বাধ্যক্ষ। রাজমন্দুরার অশ্বসমৃদ্ধি রাজার প্রধান বল। হস্ত্যধ্যক্ষের ন্যায় অশ্বব্যাপৃতকের কার্য্যও বহুল প্রকারের ছিল। অশ্বশালার