পাতা:প্রবাসী (ষট্‌ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৯০৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৯২২ মনের মধ্যে কত স্বপ্ন ভাসিয়া আসে । প্রায় সত্তর বৎসর আগেকার কথা । _/এখন চোখে দেখেন না, গ্রামের অবস্থা কি রকম দাড়াইয়াছে তাহা বৃদ্ধের চোখে পড়ে না। অবশু পরিবর্তন নিশ্চয়ই অনেক হইয়াছে। কিন্তু এখন তিনি মনের চোখ দিয়া ষে-গ্রাম, যে-বাড়ী দেখিতেছেন সে সত্তর বৎসর আগেকার গ্রাম । পাকাবাড়ী নহে, বদ্ধিষ্ণু গৃহস্থের চালাঘর। বাড়ীতে লোক খুব বেশী নয়, কিন্তু গ্রামে অনেক লোক। উঠানের চার পাশ দিয়া মজবুত বাশের বেড়, তাহার ধারে ধারে নানা রকমের গাছ উঠিয়া দুর্তেম্ভ করিয়া তুলিয়াছে। বাহিরে ও ভিতরে দুইটি পুকুর। বাহিরের পুকুরটিই বড়। পুকুরপাড়ে বিস্তীর্ণ জমি লইয়া ফুলের বাগান, দেখিলে চোখ জুড়াইয়া যায়। সাদা, লাল, গোলাপী, বেগুনী নানা রঙের ফুল, তাহাদের মধ্যে সকলের চেয়ে বেশী চোখে পড়ে বড় বড় স্থলপদ্ম । স্থলপদ্মের গাছ আগে এই বাড়ীর সকল স্থান ভরিয়া ছিল। ফিকে লাল ফুলগুলি উৎসবের বাড়ী আনন্দের রঙে রাঙাইয়া তুলিত। এখন কি আর স্থলপদ্মের গাছ আছে ? ভিতরের উঠানে শিউলি গাছগুলিই কি আর আছে ? তকতকে করিয়া নিকানো গাছের তলা, তাহার উপরে ভোরবেলায় রাশীকৃত শিউলি ফুল লাল রঙের বোট লইয়া স্তুপীকৃত হইয়া জমিয়া থাকিত। ছয়-সাতটি ছোট ছোট মেয়ে সেই ফুল কুড়াইয়া সাজি বোঝাই করিত, পূজার জন্ত তত নয়, কাপড় ছোপাইবার লোভে। এখনকার মেয়েরা কি শিউলি গাছের তলায় তেমনি করিয়া ভিড় জমায় ? এই বাড়ীর সামনের মেঠো রাস্তা নানা বাড়ীর পাশ দিয়া, উঠানের ভিতর দিয়া, জঙ্গল ভেঙ্গ করিয়া নদী অবধি গিয়াছে। ভৈরবের বুকে ডিষ্ট্ৰী লইয়া বৈঠা ঠেলিয়া খুরিয়া বেড়ান ষে কত জামোদ ছিল, সে-কথা কি আজকালকার ছেলেরা জানে । বাহাত্তর বৎসর আগের এক পূজার কথা মনে পড়িয়া স্বাস্থ । ছয় জলের ডিউীতে নয় জনে বসিয়া ভৈরবের উপর দ্বিন্ধ তাহারা পাড়ি দিয়াছিলেন এক বৈকালে, নদীর পাশে যেখানে বড় খাল বাহির হইয়া গিয়াছে সেইখানে। বড় প্রবাসী SNరిgNరి খালের মধ্য দিয়া পাড়ি দিয়া ছোট থাল, সেখান দিয়া আরও আধ ক্রোশ বৈঠা ঠেলিয়া বিস্তীর্ণ ধানের ক্ষেত। সেখানে ডিঙীতে বসিয়া নদীর ধারের একটি জিওল গাছে ডাব রাখিয়া ভাব কাটিতে গিয়া কেমন করিয়া এক জন জলে পড়িয়া গেল, কেমন করিয়া সে সেই ভিজা কাপড়ে সমস্ত পথ নৌকায় বসিয়া বাড়ী ফিরিল, কাহারও সহিত কথা কহিল না, সে-সব স্পষ্ট মনে পড়ে । আশ্চৰ্য্য ! অত দিন আগের কথা এখন সহসা মনে পড়িল কেমন করিয়া ? ঠিক যেন কালকের কথা! আরও একটা ঘটনা মনে পড়ে। ষোল বছর বয়সে এক রাত্রে বাজনা, কোলাহল, লোকের হৈচৈয়ের মধ্যে কাহারা যেন একটি ত্রয়োদশী রূপসীকে তাহার জীবনের সহিত গাঁথিয়া দিয়াছিল। ফুটফুটে স্বন্দর একটি মেয়ে। নাকে একটি মুক্তার নোলক, সারা গায়ে গহনা। ঘরের কাজ যখন করিত, মল ও চুড়ির সম্মিলিত আওয়াঙ্গে সঙ্গীত বাজিয়া উঠিত। তাহার নাম সরযু। এত দিন তাহার স্থতির কণামাত্রও র্তাহার মনে অবশিষ্ট ছিল কিলা সন্দেহ, কিন্তু আজ সব মনে পড়িতেছে। মুখখানি পরিষ্কার মনে আছে। হরেকৃষ্ণ পালের গড়া লক্ষ্মীপ্রতিমার মত মুখ ; বধু বাড়ী আসা মাত্র কেহ কেহ বলিয়াছিল। চার বছর পরে সরবু কোন দূরলোকে প্রস্থান করিল ? বৃদ্ধ অস্থির হইয়া উঠিলেন। কতটুকুই বা ঠাও। পড়িয়াছিল যাহার জঙ্ক ঘরের সব কয়টি জানালা বন্ধ করিয়া তাহাকে এমন অসহায় অবস্থায় ফেলিয়া গিয়াছে ! উ, যদি কে সব কয়টা জানাল টান করিয়া খুলিয়৷ দিত ! এই মশারিট ছিন্নভিন্ন করিয়া দুরে ফেলিয়া দিত ! হাতে কি একটুও জোর নাই ? বৃদ্ধ হাত তুলিয়া মশারি সরাইতে চেষ্টা করিলেন, হাত একটুও নড়িল না। উঠয়। বসিতে চাহিলেন, শায়িত অবস্থা হইতে এক চুলও সরিতে পারিলেন না। এতখানি অসামর্থ্য ত কোন দিনও হর নাই। তবে হয়ত এ-ই মৃত্যুর আগমনের পূর্বাভাস। মহিমারঞ্জনের সর্বাজ ঘামে জরিয়া উঠিল। না, ন, মরিতে তিনি চান না, ছিয়াশি বছর ধরিয়া যে-ধরাকে আপনার স্থখ-দুঃখ সব দিয়া ভালবাসিয়াছিলেন, তাহাকে এক কথায় তিনি ছাড়িতে পারেন না, কিছুতেই না।