পাতা:প্রবাসী (ষড়বিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/১১৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

சை প্রবাসী—বৈশাখ, ১৩৩৩ [ ২৬শ ভাগ, ১ম খণ্ড ভবিষ্যতের মানব-সমাজ কল্যাণটুকুর অধিকারী হয়, পাচ-জনকে বিতরণ করতে হবে,—এইরূপ একটি ভাব কিন্তু কোনও বিশেষ মানব-সমাজ বা জাতি নিরবচ্ছিন্ন উন্নতির পথের পথিক নয়। জন্ম, মৃত্যু, উখান, পতন, আরোহণ, অবরোহণ, ক্ষণিক অব্যাহত অবস্থান ; এই নিয়ে জাতির জীবন ; আর এইগুলি ধ’রে বিচার ক’লে কোনও জাতির জীবনের বিভিন্ন যুগগুলি আমাদের কাছে বিভিন্নরূপে দেখা দেয়। নানা উৎকর্ষ-সম্ভারে পরিপূর্ণ কোনও যুগের কথা আমরা আনন্দের , সঙ্গে খুটিয়ে আলোচনা ক’বৃতে ভালো-বাসি, আবার জাতীয় অগৌরবের কথা দুঃস্বপ্নের মতন কোনও যুগকে আচ্ছন্ন ক’রে রাখার কারণে তার বিষয়ে আলোচনা ক’বৃতে আমরা মনে-মনে অস্বস্তি অনুভব করি, আর তাকে বিস্মৃতির গর্ভে বিসর্জন করতে পালেই সাধারণ বুদ্ধিতে পরম জাতীয় লাভ ব’লে মনে করি। বাঙালীর জীবনে যে পচিশ বছর কেটে গেলো, সব দিক দিয়ে তার বিচার ক’রে আমরা আমাদের মানসিক প্রবৃত্তি বা প্রবণতা অনুসারে তাকে ভালে-বাসতে পারি বা মন্দ-বাসতে পারি—কিন্তু এই পচিশ বছর নিয়ে যে কালটা কেটে গেলে আর যার জের এখনও পুরোপুরি চ’লছে সেটা যে বাঙালীর পক্ষে বিশেষ এক ‘সাংঘাতিক যুগ সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। নানা সংঘাত বাঙালীর জীবনে এসে পড়েছে—বিভিন্ন ভাবের বিচার আর চিন্তা-প্রণালীর সংঘাত, ভিতরের আর বাইরের নানা জাতের সংঘাত-এসবে বাঙালীকে অস্থির করে তুলেছে, তার ভবিষ্যৎ অতি অস্পষ্ট দেখাচ্ছে । কিন্তু এই কাটা বনে একটি মিষ্টি ফল— বাঙালীর মন এখনও সতেজ আছে—এই পচিশ বছরের নানা অক্ষমতার অবিমূৰ্য্যকারিতার মধ্যে,প্রতিকুল অবস্থার কঠিন পাথরের দেয়ালে পথ না পেয়ে মাথা ঠুকে বেড়ানোর মধ্যে, সামাজিক আর রাষ্ট্রীয় নানা বিপত্তির মধ্যে এক রকম হাত-পা-বধা হ’য়ে থাকৃলেও, সব চেয়ে বড়ে কথা বাঙালীর পক্ষে এই যে বাঙালী মানসিক উৎকর্ষের ক্ষেত্র বিশ্বের দশ-জনের একজন হ’তে পেরেছে ; সে যে বড়ে ঘরের ছেলে, আর পাচ-জনের সম্বন্ধে তার দায়িত্ব আছে, সে নিঃশ্বের মতন খালি গ্রহণ করে খুশী থাকতে পারে না, তাকেও নিজে যথাশক্তি কৃতিত্ব অর্জন ক’রে তার মনের মধ্যে এসেছে। অবস্থাগতিকে প'ড়ে রাজনৈতিক বা আর্থিক ক্ষেত্রে বাঙালীর উন্নতি হয়নি, কিন্তু বিজ্ঞান, দর্শন, রূপ-সাধন,সাহিত্য এইসবের আসরে বাইরে থেকে যে নিমন্ত্রণ সে পেয়েছে তা সে সাদরে অঙ্গীকার ক’রে নিয়েছে ; তার বাহ ঐশ্বৰ্য্যের আর শক্তির অভাবের জন্য অবশ্যম্ভাবী দৈন্য তাকে পদে-পদে বাধা দিলেও সে আর পাচটি সভ্য জাতির সমাজে উচ্চ আসন পেয়েছে। বাঙালীর আধুনিক ইতিহাসের প্রথম কল্পে, নবীন ভারতের প্রতিষ্ঠাতা মহাত্ম রামমোহন রায় ভারতের সামনে যে আদর্শ ধ’রেছিলেন, গত পচিশ বছরের মধ্যে সে আদর্শ নেতুন করে বাঙালীর সাম্নে এসেছে ; সব বিষয়ে বাঙালীর সাধনাকে তার যে বিশেষত্ব—জাতীয়তার সঙ্গে বিশ্বজনীনতা, তার দ্বার উজ্জীবিত ক’রে দিচ্ছে । বিদ্যায়, বিজ্ঞানে, রসস্থষ্টিতে আধুমিকের মধ্যে প্রাচীনকে পূর্ণতর ক’রে তুলতে হবে, আধুনিককে বর্জন ক’লে চলবে না, কারণ তা-হ’লে প্রাচীন তার যথার্থ স্বরূপে দেখা দেবে না— এই যুগে বাঙালী এই কথা তার শ্রেষ্ঠ মতির দ্বারা বুঝেছে। যুগধৰ্ম্মের আহবান বাঙালী শুনেছে, তার বাণী বাঙালী হৃদয়ঙ্গম ক’বৃতে পেরেছে —তার আহবানের কথা আর তার প্রত্যুত্তরে বাঙালীর কৰ্ত্তব্য, চেষ্টা আর সাফল্য, এই দুইটি কথা ‘প্রবাসী গত পচিশ বছর ধ’রে বাঙালীর কাছে বলে আছে। এইরূপেই প্রবাসী বাঙালী জাতের সেবা ক’রেছে—আর এই সেবা ‘প্রবাসী যে খালি বাঙালী জাতকেই ক’রে এসেছে তা নয়, এই সেবা বাঙালী জাতের মধ্য দিয়ে ‘প্রবাসী বিশ্বমানবকেও ক’রে এসেছে। কারণ মানসিক উৎকর্ষ এখন কেবল জাতি-বিশেষের মধ্যে বদ্ধ নয়, কোনও একটা জাত এ ক্ষেত্রে যদি কিছু লাভ ক’বৃতে পারে তার স্বফল এখন গিয়ে পৌছয় সমগ্র মানব সমাজে ; আর যদি কোনও ব্যক্তি বা আয়তন বা পত্ৰগোষ্ঠী একটি কোনও জাতিকে তার শ্রেষ্ঠ বিচার বা ভাবসম্ভারকে আবিষ্কার ক’রে মানব-সমাজকে দান করতে আহবান করে, বা সাহায্য করে, তী-হ’লে তায় এই সাধুচেষ্টার ফল কেবল সেই জাতি-বিশেষের মধ্যেই বদ্ধ রইলো না, একথ} ব’লতে পারা যায়।