পাতা:প্রবাসী (ষড়বিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৪২৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

২য় সংখ্যা । উপরে বর্ণিত সেই প্রস্তুততার যুক্তি। এইরূপ সাম্প্রদায়িক প্রস্তুততার একটা অবশ্যম্ভাবী ফল হইবে, হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে মারামারিতে নিপুণ শ্রেণীর প্রভাব বৃদ্ধি। তাহারা নিজেদের বাহাদুরী দেখাইতে ব্যগ্র থাকিবে । সেইজন্য মধ্যে মধ্যে সংঘর্ষ ঘটিবে। তা ছাড়া, যুক্তির দিক্ দিয়াও ইহাতে ভুল আছে। ভারতবর্ষের প্রত্যেক প্রদেশে, জেলায়, নগরে ও গ্রামে হিন্দু বা মুসলমানের আপেক্ষিক সংখ্যা ও বল এক নহে, এক হইতে পারে না। কোথাও কোথাও হিন্দু, কোথাও কোথাও মুসলমান, সংখ্যায় ও বলে নিকৃষ্ট হইবে। বৰ্দ্ধমানে দাঙ্গ হইলে চট করিয়া আকাশপথে দিল্লীর মুসলমান সধৰ্ম্মীদের সাহায্যার্থে আসিতে পারিবে না, চট্টগ্রামে দাঙ্গ হইলে তৎক্ষণাং কাশীর হিন্দুরা এরোপ্লেনে হিন্দু সধৰ্ম্মীদের সাহায্য করিতে আসিবে না। অবশ্য আমরা কোন পক্ষকেই দুৰ্ব্বল ও ছত্রভঙ্গ অবস্থায় থাকিতে পরামর্শ দিতেছি না। পরস্পর মারামারি কাটাকাটি করিবার প্রয়োজন ও ইচ্ছা না থাকাই ভাল ; কিন্তু তাহা না থাকিলেও দৈহিক ও মানসিক বলের অন্য প্রয়োজন আছে। সম্প্রদায়নির্বিশেষে দুষ্টের দমনের জন্য ও তাহদের অত্যাচার হইতে আত্মরক্ষার ও দুৰ্ব্বলের রক্ষার জন্য শক্তির প্রয়োজন । অন্য সকল প্রকার সিদ্ধির জন্যও শক্তি আবশ্যক । সুতরাং আমরা শক্তিচর্চার বিরোধী নহি । আমরা কেবল ইহাই বলিতে চাই, যে, বলিষ্ঠ ও দলবদ্ধ হইলেই শুধু তাহার দ্বারাই হিন্দুমুসলমানে শান্তি স্থাপিত হইবে না। তাহাতে নিশ্চয়ই কিছু স্বফল হইবে। কিন্তু তাহাকে একমাত্র বা প্রধান উপায় মনে করিলে উন্ট ফল ফলিতে পারে। যেমন দেশে দেশে যুদ্ধ কেবলমাত্র “প্রস্তুততা” দ্বারা নিবারিত হয় নাই, তেমনি নান ধৰ্ম্মসম্প্রদায়ের সংঘর্ষ কেবলমাত্র “প্রস্তুততা” দ্বারা নিবারিত হইবে না। যেমন দেশ ও জাতির মধ্যে সামরিক দলকে সংযত রাখা অন্তজাতিক শাস্তির জন্য আবশ্বক, তেমনি সাম্প্রদায়িক সংঘর্য ও অশান্তি নিবারণের জন্যও প্রত্যেক সম্প্রদায়ের মধ্যে দাঙ্গাদক্ষ ও গোড়া এই দুই দলকে সংযত রাখা দরকার । সাম্প্রদায়িক সংঘর্য নিবারণের জন্য সৰ্ব্বশ্রেষ্ঠ ও সৰ্ব্বপ্রধান উপায় পরস্পরের মধ্যে সম্ভাব বৃদ্ধির চেষ্টা । সম্ভাব বৃদ্ধির উপায় সম্বন্ধে আগে আগে অনেক কথা লিখিয়াছি, পরেও হয়ত লিখিব। এখানে কেবল ২।১টি কথা বলি। • মানুষকে প্রধানতঃ হিন্দু বা মুসলমান বা খৃষ্টিয়ান বা অন্য কিছু মনে করিয়া তাহার সম্বন্ধে একটা কু বা স্ব ধারণা পোষণ না করিয়া মানুষ হিসাবেই তাহার বিচার করা উচিত। ইহা কঠিন কাজ, বিশেষতঃ গোড়াদের مر الإسط م 6 বিবিধ প্রসঙ্গ হিন্দুমুসলমান সমস্যা SDSX) পক্ষে, কিন্তু অসাধ্য নহে। অনেক মুসলমান নিশ্চয়ই প্রাত্যহিক ব্যবহারে অনেক হিন্দুকে সৎ ও বিশ্বাসযোগ্য দেখিয়াছেন ; অনেক হিন্দুও অনেক মুসলমানকে এইরূপ দেখিয়াছেন। গোড়ামি ও ধৰ্ম্মোন্মত্ততা পরিহার না করিলে মানুষকে কেবল মানুষ হিসাবে বিচার করিবার অভ্যাস জন্মে না । কেবল নিজেদের জিদ বজায় রাখিবার চেষ্টা না করিয়া, অন্তের ধৰ্ম্মবিশ্বাস এবং সামাজিক প্রথা অনুসারে যাহা প্রয়োজন, তাহাও বুঝিতে চেষ্টা করিতে হইবে । পরস্পরের ইতিহাসে, ধৰ্ম্মে, ও সভ্যতায় ভাল যাহা আছে, তাহ বুঝিতে চেষ্টা করা উচিত। সম্ভবতঃ হিন্দুদের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার অধিকতর হওয়ায় যত হিন্দু লেখক মুসলমান সভ্যতার গুণগ্রহণ যতটা করিয়াছেন, কোন মুসলমান লেখক হিন্দুসভ্যতার গুণগ্রহণ ততটা করেন নাই। অথচ অধিকাংশ ভারতীয় মুসলমান হিন্দুবংশজাত ; স্থতরাং হিন্দুসভ্যতার শ্রেষ্ঠ অংশের জন্য আপনাদিগকে গৌরবান্বিত মনে করা তাহাদের পক্ষে স্বাভাবিক হওয়া উচিত ছিল। একটা দৃষ্টান্ত দিলে ইহা সহজে বুঝ। যাইবে। প্রাচীন গ্রীক ও রোমকের খৃষ্টয়ান ছিলেন না ; তাহদের মধ্যে অধিকাংশ লোক বহুদেবদেবীপূজক এবং অল্পসংখ্যক লোক একেশ্বরবাদী ছিলেন। পরে ক্রমে ক্রম সকলেই, অন্ততঃ নামে, খৃষ্টিয়ান , হইয়াছেন। খৃষ্টধৰ্ম্ম জুডিয়া-দেশ-জাত। কিন্তু বৰ্ত্তমান গ্রীক ও রোমকেরা খুষ্টিয়ান হইলেও প্রাচীন সভ্যতার অহঙ্কার করিতে হইলে জুডিয়া দেশের ইহুদীসভ্যতার অহঙ্কার করেন না, প্রাচীন গ্রীক ও রোমক সভ্যতারই অহঙ্কার করেন, যদি ও সে সভ্যতা খৃষ্টিয়ান সভ্যতা নহে । অন্যদিকে, ভারতীয় মুসলমানের সাধারণতঃ প্রাচীন সভ্যতার অহঙ্কার করিতে হইলে ভুলিয়াও ভারতীয় হিন্দু বা বৌদ্ধ যুগের সভ্যতার অহঙ্কার করেন না, যদিও তাহারা অধিকাংশ হিন্দুবংশজাত । র্তাহারা অহঙ্কার করেন প্রাচীন আরবীয় সভ্যতার কিম্বা পারস্য বা তুরস্কের সভ্যতার, যদিও তাহাদের অধিকাংশের দেহে একবিন্দুও আরর, পারসীক বা তুর্ক রক্ত নাই। র্তাহাদের মধ্যে প্রকৃত শিক্ষার বিস্তার হইলে হয় ত তাহারা প্রকৃতিস্থ হইবেন । হিন্দুমুসলমান সমস্যার সমাধানের জন্য যতগুলি উপায় অবলম্বিত হইতে পারে, তাহার মধ্যে দুটির উল্লেখ করিয়াছি। প্রথম ও প্রধান উপায়, পরস্পরকে বুঝা এবং পরস্পরের মধ্যে সম্ভাব বৃদ্ধি। দ্বিতীয় উপায়, নিজ নিজ দুৰ্ব্বলতা দূর করিয়া সবল হইয়া অপরের অবজ্ঞা ও আক্রমণ হইতে আত্মরক্ষার শক্তি অর্জন । আমরা শুধু দৈহিক বল ও অস্ত্রবলের কথা বলিতেছি না।