পাতা:প্রবাসী (ষড়বিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৭৮১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

१ ३ প্রবালী—ভাদ্র, ১৩০৩ [ ২৬শ ভাগ, ১ম খণ্ড টানিয়া ধরিয়াছিল সময়ের বিচিত্র রাগিণীর আলাপে তাহা আপনি শিথিল হইয়া আসিতেছে। শিশু গৌরী বাহিরের মুক্ত আবহাওয়ায় আর আসন্ন কৈশোরের উদ্দীপনায় অনেকখানি বড় হইয়া উঠিয়াছে ; পৃথিবীর সঙ্গে তাহার এই যে পরিচয় তাহার দেহ-মনকে যতথানি পুষ্টি দান করিয়াছে, ঘরের আবেষ্টন তাহাকে তা বহুদিনেও দিতে পারিত না । সেখানে কৃত্রিম উত্তাপে আস্বাস্থ্যকর অনাবশ্যক মানসিক স্ফীতিটা হয়ত অনেক বেশীই হইত, কিন্তু তাহার তলায় তলায় প্রাণরসের এই সতেজ দীপ্তি কোথাও খুজিয়া মিলিত না। বুকের রস শোষণ করিয়া লতা যেমন বাড়িয়া উঠে, তেমনি স্বচ্ছন্দ অবাধ গতিতে সে বাড়িয়া উঠিয়াছে নূতন লতারই মত। সঙ্গীহীন প্রবাসে প্রবাসে পিতামাতাই তাহার সখ্য ও প্রীতির আধার ; পিতাই তাহার শিক্ষাদীক্ষা ও সকল রকম মনের খোরাকের জোগানদার। বর্ষার প্লাবনে যখন দেশ ভাসিয়া যাইতেছে তখন প্রয়াগতীর্থে যমুনা নদীর তীরে একখানা বহু পুরাতন নবাবী আমলের পাথরের ঝরোকা দেওয়া ছোট বাড়ীতে কিছুদিনের জন্য হরিকেশব আশ্রয় লইয়াছিলেন। পাথরবাধানে সরু ঝোলানো বারান্দ হইতে তরঙ্গ-আকুল যমুনার উন্মত্ত গতি দেখা যাইত, ঘরের ভিতর হইতেই তাহার ক্রুদ্ধ গর্জন শোনা যাইত। গৌরীর সারাদিন কাটিত সেই বারান্দার ধারে । সেখানে সে কখনও পিতার কাছে পড়াশুনা করিত, কখনও আপন মনে যমুনার তীরভাসানো নিষ্ঠুর লীগা দেখিয়াই তাহার সময় কাটিত। ভোর না হইতে তিনজনে মিলিয়া দীর্ঘ তরুবীথির তলায় তলায় কোনো দিন গঙ্গাস্নান-যাত্রা কোনো দিন বা যমুনামান-যাত্রায় বাহির হইয়া পড়িতেন। পথযাত্রী মুসাফিরের দল এই ফুলের মত মেয়েটির দিকে ম্মিতমুখে একবার না তাকাইয়া পারিত না। সাধু সন্ন্যাসী ভিখারী তাহারই কাছে আসিয়া হাত পাতিয়া বলিত, “ম, তোর ভলা হোবে, রাজরাণী হোবে, কুচু ভিচ্ছা মিল যায়।” সন্ধ্যায়ও পথচলার আর এক পৰ্ব্ব ছিল । তখন তরঙ্গিণী বাহির হইতেন না। গৌরী তাহার পিতার পিছন পিছন ছুটিয়া ছটিয়া যমুনার পারে মাটির' কি গঙ্গার ধারে কিম্বা খঞ্জবাগে বেড়াইতে না গিয়া থাকিতে পারিত না । অকস্মাৎ বৃষ্টির আবির্ভাবে কত দিন তাহারা আপাদমস্তক স্বান করিয়া ফেলিত, কতদিন পথের পাশ্বে অজান লোকের দালানে কি মন্দিরের রোয়াকে দীর্ঘকাল দাড়াইয়া দাড়াইয়৷ শ্ৰান্ত হইয়া পড়িত, তবু তাহাদের এ খেয়ালের শেষ ছিল না। পথের লোকে যে গৌরীকে দেখিয়া খুলী হয়, সেট। সে বেশ বুঝিত এবং সেজন্য তাহার মনে সগৰ্ব্ব একটা আনন্দের কিছুমাত্র অভাব ছিল না । বিদেশী লোকের পাস্থশালায় ক্ষণিকের আসা-যাওয়ার পথে আর পাচট। স্বভাবসৌন্দর্ঘ্যের মতই গৌরীকেও একবার দেখিয়৷ আবার নিজের স্বদূর আবাসে ফিরিয়া যাইত, কাজেই তাহাদের মুখ মনে উদয় হইয়াই সঙ্গে সঙ্গে মিলাইয়াও যাইত। কিন্তু হঠাৎ একদিন আবির্ভাব হইল এক স্বদেশী মূৰ্ত্তির। প্রথম কয়েকদিন গৌরী কিছুই লক্ষ্য করে নাই । তারপর একদিন অকস্মাৎ সে অনুভব করিল সকালে সন্ধ্যায় পাথরের বারান্দায় আনমনে যখন সে পায়চারি করে, অথবা কোনো কাজে আকাজে এই দিকে আসা-যাওয়া করে তখন বিশেষ একজন মানুষ প্রায়ই বারকয়েক করিয়া বারান্দার তলা দিয়া ঘুরিয়া যায়। গৌরীর কৌতুহল হইল, সে দুই একদিন ঝুঁকিয়া পড়িয়া মানুষটিকে দেখিল। বুঝিল, গৌরীকে দেখ তাহার আগ্রহ আছে, কিন্তু সেই সঙ্গে আর কাহাকে ৩ দেখিলেই সে সরিয়া যায়। মানুষটির এই লুকোচুরির দেখা সে বিস্মিত হইয়া পৰ্য্যবেক্ষণ করিত কিন্তু পুরাপুরি বুঝিয়া উঠিতে পারিত না। মানুষের মানুষকে দেখার মধ্যে ভাল লাগার সঙ্গে একটা যে গোপনতার প্রয়াস থাকিতে পারে তাহা এই মানুষটির ব্যবহারে এই প্রথম সে অনুভব করিতে আরম্ভ করিল। কিন্তু এই গোপনতার অন্তরালের দেখাশুনা কি নিষিদ্ধ কিছু, না ভালই তাহা সে ঠিক ঠাওর করিতে পারিল না। তাহার কৌতুহলের সঙ্গেই কেমন একটা ভয় হইল ; দিনকতক সে বারান্দায় যাওয়া ছাড়িয়া দিল । যমুনার ওপারের স্বদীর্ঘ আম্ৰবীথির তলায় ধূলিধূসর জনবিরল পথে মাইল দুই চলিয়া সেদিন গৌরী যখন