পাতা:প্রবাসী (ষড়বিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৮৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্য-সম্মিলন শ্ৰী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন আমরা কোনো সত্যবস্তুকে পাই তাহাকে রক্ষণপালনের জন্য বাহির হইতে উপরোধ বা উপদেশেব প্রয়োজন হয় না। কোলের ছেলে মানুষ করিবার জন্য মাতাকে গুরুর মন্ত্র বা স্মৃতিসংহিতার অনুশাসন গ্রহণ করিতে বলা অনাবশ্যক । বাঙালী একটি সত্য বস্তু পাইয়াছে, ইহা তাহার সাহিত্য। এই সাহিত্যের প্রতি গভীর মমত্ব স্বতই বাঙালীর চিত্তকে অধিকার করিয়াছে। এইরূপ একটি সাধারণ প্রীতির সামগ্ৰী সমগ্র জাতিকে যেরূপ স্বাভাবিক ঐক্য দেয়, এমন আর কিছুই না। স্বদেশে বিদেশে আজ যেথানে বাঙালী আছে সেখানেই বাংলা সাহিত্যকে উপলক্ষ্য করিয়া যে সম্মিলন ঘটিতেছে। তাহার মতে। অরুত্রিম আনন্দকর ব্যাপার আর কি আছে ? ভিক্ষা করিয়া যাহা আমরা পাই তাহা আমাদের আপন নহে, উপার্জন করিয়া যাহা পাই, তাহাতেও আমাদের আংশিক অধিকার ; নিজের শক্তিতে যাহ। আমরা স্বষ্টি করি, অর্থাৎ যাহাতে আমাদের আত্মপ্রকাশ, তাহার পরেই আমাদের পূর্ণ অধিকার। যে-দেশে আমাদের জন্ম সেই দেশে যদি সৰ্ব্বত্র আমাদের আত্মা আপন বহুধা শক্তিকে নানাবিভাগে নানারূপে স্মৃষ্টিকাৰ্য্যে প্রয়োগ করিতে পারিত, তবে দেশকে ভালোবাসিবার পরামর্শ এত উচ্চস্বরে এবং এমন নিষ্ফলভাবে দিতে হইত না । দেশে আমরা আত্মপ্রকাশ করি না বলিয়াই দেশকে আমরা আকৃত্রিম আনন্দে আপন বলিয়া জানি না। বাংলা সাহিত্য আমাদের স্বষ্টি। এমনকি, ইহ আমাদের নূতন হষ্টি বলিলেও হয়। অর্থাৎ ইহা আমাদের দেশের পুরাতন সাহিত্যের অম্লবৃত্তি নয়। আমাদের প্রাচীন সাহিত্যের ধারা ষে-থাতে বহিত, বর্তমান সাহিত্য সেই খাতে বহে না। আমাদের দেশের অধিকাংশ আচারবিচার পুরাতনের নিজাব পুনরাবৃত্তি । বৰ্ত্তমান অবস্থার সঙ্গে তাহার অসঙ্গতির সীমা নাই, এইজন্য তাহার অধিকাংশই আমাদিগকে পদে পদে পরাভবের দিকে লইয়া যাইতেছে। কেবল আমাদের সাহিত্যই নূতন রূপ লইয়া নূতন প্রাণে নূতন কালের সঙ্গে আপন যোগসাধন করিতে প্রবৃত্ত। এইজন্য বাঙালীকে তাহার সাহিত্যই যথার্থভাবে ভিতরের দিক্ হইতে মানুষ করিয়া তুলিতেছে। যেখানে তাহার সমাজের আর সমস্তই স্বাধীন পন্থার বিরোধী, যেখানে তাহার লোকাচার তাহাকে নির্বিচার অভ্যাসের দাসত্ব-পাশে আচল করিয়া বাধিয়াছে, সেখানে তাহার সাহিত্যই তাহার মনকে মুক্তি দিবার একমাত্র শক্তি। বাহিরে যখন সে জড় পুত্তলীর মতে হাজার বৎসরের দড়ির টানে বাধা কায়দায় চলা-ফেরা করিতেছে, সেখানে কেবল সাহিত্যেই তাহার মন বে-পরোয়া হইয়া ভাবিতে পারে, সেখানে সাহিত্যেই অনেক সময়ে তাহার অগোচরেও জীবন-সমস্যার নূতন নূতন সমাধান, প্রথার গণ্ডি পার হইয় আপনিই প্রকাশ হইতেছে। এই অস্তরের মুক্তি একদা তাহাকে বাহিরেও মুক্তি দিবে। সেই মুক্তিই তাহার দেশের মুক্তির সত্যকার ভিত্তি। চিত্তের মধ্যে যে মাকুম বন্দী, বাহিরের কোনো প্রক্রিয়ার দ্বারা সে কখনোই মুক্ত হইতে পারে না। আমাদের নব সাহিত্য সকল দিক্ হইতে আমাদের মনের নাগপাশ-বন্ধন মোচন করুক ; জ্ঞানের ক্ষেত্রে, ভাবের ক্ষেত্রে শক্তির স্বাতন্ত্র্যকে সাহস দিক, তাহা হইলেই একদা কৰ্ম্মের ক্ষেত্রেও সে সত্যের বলে স্বাধীন হইতে পারিবে। ইন্ধনের নিজের মধ্যে আগুন প্রচ্ছন্ন আছে বলিয়াই বাহিরের আগুনের স্পর্শে সে জলিয় ওঠে, পাথরের উপর বাহির হইতে আগুন রাখিলে সে ক্ষণকালের জন্য তাতিয়া উঠে, কিন্তু সে জলে না । বাংলা সাহিত্য বাঙালীর মনের মধ্যে সেই ভিতরের আগুনকে সত্য করিয়া তুলিতেছে ; ' ভিতরের দিক্ হইতে তাহার মনের দাসত্বের জাল ছেদন করিতেছে । একদিন যখন এই আগুন বাহিরের দিকে জলিবে, তখন ঝড়ের ফুৎকারে সে নিবিবে না, বরং বাড়িয়া উঠিবে। এখনি বাংলা দেশে আমরা তাহার প্রমাণ পাইয়াছি। বৰ্ত্তমান কালের রাষ্ট্রক আন্দোলনের দিনে মত্ততার তাড়নায় বাঙালী যুবকেরা যদি-বা ব্যর্থতার পথেও গিয়া থাকে, তবু আগুন যদি ভারতবর্ষের কোথাও