পাতা:প্রবাসী (ষড়বিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৯৮৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৬ষ্ঠ সংখ্যn ] রিক্সওয়ালা

>ግ

তাহাকে একটু অপেক্ষু করিতে বলিয়া বলিলাম—আমার আর-একজন সঙ্গী আছে। করুণ ভাবে আমার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া সে আমাকে অন্য গাড়ী দেখিতে অঙ্গুরোধ করিল—দুইজনকে সে লইতে পারিবে না। আমি এতদূর বিস্মিত ও কৌতুহলাক্রাস্ত হইলাম যে, বন্ধুর অপেক্ষা না করিয়াই রিক্সতে চড়িয়া বসিলাম । সেদিনও আকাশ ব্যাপিয়া মেঘ করিয়া আসিতেছিল ; ঘন ঘন মেঘ-গর্জন ও বিদ্যুৎচমকে কলিকাতার চঞ্চল আকাশ স্তব্ধ হইয়া আসিয়াছিল। আসন্ন দুৰ্য্যোগের আশঙ্কায় রাস্তায় লোক-চলাচল অনেকটা কম। রিকাওয়ালাকে তাড় দিলাম—অবিলম্বে বৃষ্টি নামিবে—শীঘ্র বাড়ী পৌছান চাই । জোরে টানিতে গিয়া রিক্সওয়ালা গলদঘৰ্ম্ম হইয়া উঠিল ; অবাক হইলাম। আমার মত ক্ষীণকায় পুরুষকে টানিতে এতটা পরিশ্রম হইবার কথা নয়। আগের দিনের মত একটা অজানা অস্বস্তিকর অমৃভূতি মনে জাগিতে লাগিল। অমন বিপুলকায় একট। লোক আমার মত একটি সামান্য বোঝাকে টানিতে পারিতেছে না, ইহার কোনো সঙ্গত কারণ খুজিয়া পাইলাম না ; একটা অস্পষ্ট অলৌকিক ভয় মনকে পীড়া দিতে লাগিল । বেচারার দুরবস্থা দেখিয়া মায়া হইল ; শুধু বোঝা টানার পরিশ্রম ছাড়াও অন্য কোনো যন্ত্রণ তাহার হইতেছিল তাহারও আভাস পাইতেছিলাম। নানা কল্পনা করিয়া কোনো কিনারা করিতে পারিলাম না। তাহাকে যথেচ্ছ রিক্স টানিতে বলিয়া একটা সিগারেট ধরাইলাম । কৌতুহল-নিবৃত্তি করিবার যথেষ্ট ঔংস্থক্য হওয়া সত্ত্বেও চুপ করিয়া কি ভাবে কথাটা পাড়িব ভাবিতে লাগিলাম । হঠাৎ চড়, বড়, করিয়া বৃষ্টি নামিল। রিক্সওয়াল চকিত হইয় উঠিল। একটা বাড়ীর গাড়ীবারান্দার ধারে আসিয়া তাহাকে থামিতে বলিলাম। দু’জনে গাড়ীবারান্দার নীচে আসিয়া মাথা মুছিয়া বৃষ্টি থামিবার অপেক্ষা করিতে লাগিলাম । রিক্সওয়ালাকে একটা সিগারেট দিলাম। সে বিনীত সেলাম করিয়া সিগারেট লইয়া ফুটপাতের উপর উবু হইয়া বসিয়া সিগারেট ধরাইল। আমি দাড়াইয়া রহিলাম। আমার মনের অদম্য কৌতুহল আমাকে ভিতর হইতে ঠ্যাল দিতে লাগিল, কিন্তু পাছে বেফাস কিছু জিজ্ঞাসা করিয়া ফেলি—এই ভয় হইতে লাগিল। তাহার নাম কি, কোথায় থাকে, তাহার কে আছে এগুলি বেশ সহজ ভাবেই জিজ্ঞাসা করিতে পারিলাম। তাহার নাম মকবুল, হাতীবাগানের বস্তীতে থাকে, এক বৃদ্ধা ফুফু ছাড়া তাহার কেহ নাই ; শিশু অবস্থা হইতেই সে পিতৃমাতৃহীন—ফুফুর হাতেই সে মানুষ হইয়াছে। বিবাহ হইয়াছে, কি না জিজ্ঞাসা করাতে সে গভীর দীর্ঘ-নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল,—বাবু, যে-বোঝ। তাহাকে নিরস্তর টানিয়া বেড়াইতে হইতেছে তাহ লইয়াই সে অস্থির—ইহার উপর জরুর বোঝা বহিতে সে অক্ষম । বলিলাম—বুড়ী ফুফু ছাড়া তাহার কেহ নাই, অথচ অহরহ বোঝা বহিতে হইতেছে, ইহার অর্থ ত বুঝিলাম না । মকবুল চুপ করিয়া রহিল । আমি তাহাকে চিন্তা করিবার অবসর না দিবার জন্য বলিলাম—একট। বিষয়ে আমার ভারী কৌতুহল আছে । কিছুকাল আগে নিমতলাঘাটের কাছে তাহাকে দেখিয়াছিলাম—আজও দেখিলাম ;—দুই দিনই সে একজনের অধিক সোওয়ার লইতে অস্বীকার করিয়াছে অথচ সে দুৰ্ব্বল নয়। ইহার নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে । যদি বিশেষ আপত্তি না থাকে তাহা হইলে— মকবুল চমকিয়া উঠিল । তাহার মুখ অস্বাভাবিক রকম বিবর্ণ হইয়া গেল। হাত দিয়া মাথার রগ টিপিতে টিপিতে সে বলিল—বাবু সে বড় ভয়ানক কথা । ষেকথা মনে হইলেই সে আতঙ্কে শিহরিয়া উঠে, তাহার বুকের তাজা রক্ত হিম হইয়া যায় মুখে সে-কথা সে প্রকাশ করিবে কেমন করিয়া । বলিঙে বলিতে সে সভয়ে রিক্সখানির দিকে চাহিল । কি যেন একটা ভয়াবহ কিছু দেখিয়া সে শিহরিয়া উঠিল । পরক্ষণেই সে উন্মত্তের মত ছুটিয়া গিয়া তেরপলের পরদ দিয়া রিক্সখানি মুড়িয়া ফেলিয়া কঁাপিতে কঁাপিতে আসিয়া হতাশ ভাবে বসিয়া পড়িল । তখনও ঝম্ ঝম্ করিয়া বৃষ্টি পড়িতেছে। মুহুর্মুহু বিদ্যুৎ-ঝলকে কি যেন একটা অনন্ত রহস্যের ক্ষণিক আভাস মাত্র পাইভেছিলাম ; জলভারাক্রাস্ত বাতাস কলিকাতার