পাতা:প্রবাসী (ষড়বিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৯৮৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

• *}ly পাষাণ-প্রাচীরে প্রতিহত একটা একটানা উচ্ছ্বাসের স্বষ্টি করিতেছিল। রাস্তায় জনমানবের চিহ্ন ছিল না। তাহাকে আর-একটা সিগারেট দিয়া আমি তাহার কাছ ঘোঁসিয়া দাড়াইলাম। কি যেন একটা অজানা ভয়ে আমার মনও পীড়িত হইতে লাগিল । ব্যাপারটা আগাগোড়া এমন অস্বাভাবিক—মাঝে মাঝে সমস্তটা স্বপ্ন বলিয়া উড়াইয়া দিতেছিলাম ; কিন্তু সম্মুখে উপবিষ্ট বিক্সওয়ালার অস্বাভাবিক-দীপ্তি-সম্পন্ন চোখদু’টি আমাব মনে এক অলৌকিক ভয় জাগাইতেছিল—আমি স্তব্ধ হইয় দাডাইয়া ছিলাম। 曾 কিন্তু এভাবে বসিয়া থাক। চলে না—বাড়ী যাইতে হইবে। এব্যাপারটা সম্বন্ধে বিস্তারিত না জানিয়াও যাওয়া যায় না। বলিলাম, মকুবুল, এসব কথা ভাবিতে যদি তোমার বিশেষ কষ্ট হয় কিছু বলিবার প্রয়োজন নাই —বৃষ্টি অনেকটা কমিয়া আসিয়াছে , এখন যাওয়া যাইতে পারে । সজোরে আমার পা দুইটি চাপিয়া ধরিয়া অধীরভাবে সে বলিয়া উঠিল—আর একটু দাড়ান বাবু । যে-কথা তিন বছর ধরিয়া বলিবার জন্য আমি ব্যাকুল— অথচ কাহাকেও মুখ ফুটিয়া বলিতে পারিলাম না—আজ আমাকে বলিতে দিন ; এ যন্ত্রণ সহিতে আর পারিতেছি अ| | নিবিড় সহানুভূতিতে চিত্ত ভরিয়া গেল। ভুলিয়া গেলাম, আমি মকবুল অপেক্ষ সামাজিক হিসাবে শ্রেষ্ঠ লোক ; তাহার সহিত এভাবে কলিকাতার রাস্তার ফুটপাতে দাড়াইয়া আলাপ করা আমার পক্ষে হীনতাসূচক ! সেই ব্যথাক্লিষ্ট মানুষটির গোপন কথা শুনিবার জন্ত উৎকর্ণ হইয়া রহিলাম । f মক্কুল অতি ধীরে ধীবে থামিয়া থামিয়া হিন্দিমিশ্রিত বাঙলায় যাহা বলিল এবং যাহা বলিল না— সবটুকু মিলিয়া যাহা বুঝিলাম তাহাই ভাষায় লিপিবদ্ধ করিতেছি । মকবুল বলিল—বাবু, আমি আপনাকে ব্যাপারটা ঠিক বুঝাইতে পারিব কি না জানি না। . ঘটনাট এমন অসম্ভব আর এমনি ভয়াবহ যে, বিশ্বাস করা কঠিন । কিন্তু খোদার কসম বাবু আমি একটিও প্রবাসী-আশ্বিন, ১৩৩৩ [ ২৬শ ভাগ, ১ম খণ্ড মিথ্যা বলিব না! আমি আজ তিন বৎসর ধরিয়া এই গাড়ীতে এক মৃতদেহের বোঝা টানিন বেড়াইতেছি। একজনের অধিক লোককে গাড়ীতে উঠিতে দিতে পারিব কেমন করিয়া ? আর একজন যে নিরস্তব আমার গাড়ীতে বসিয়া আছে । তাহার নড়িবার শক্তি নাই—আমি তাহাকে বহন করিয়া লইয়া ফিরিতেছি। ইহার হাত হইতে আমার নিস্তার নাই । মৃতদেহ পচিযা ভারী হইয়া গিয়াছে ; আমি অহরহ দুর্গন্ধে অস্থিব হইতেছি । মৃতদেহের ভার টানিয়া টানিয়া আমাব সবল দেহ জীর্ণ হইয়া আসিল—এই অদৃশ্য শবদেহের ভাবে আমি জজরিত হইয়া পড়িয়াছি—আমি আর বঁাfচব না বাবু । মনে হইল, উপকথা শুনিতেছি ; মনে হইল, কলিকাতাব আবেষ্টনী ধোয় হইয়া কোথায় মিলাইয়া গিয়াছে। এক জনশূন্ত মরুভূমিব মাঝে আমরা দুইজনে পড়িয়া আছি । এক অদ্ভুত অনুভূতিতে আমাব সমস্ত চেতনা বিলুপ্তপ্রায় হইল। আমি স্তব্ধ হইয়া শুনিতে লাগিলাম— তিন বছর আগেকার কথা। সেদিন প্রবল বর্ষণে কলিকাতা সহর ধুইযা মুছিযা গিয়াছিল। রাত্রি নট। দশটার সময় আমি এই গাড়ীখান লইয়! হাওড়া ষ্টেশনে সোওয়ারীর প্রতীক্ষা করিতেছিলাম। সেখানে দুই চাব খান মাত্র গাড়ী ছিল ; লোকের ভিড় ছিল না বলিলেই হয় ; আমন দিনে সাধারণতঃ কুকুর-বিড়ালেরাও বাড়ীর বাহির হয় না ; কিন্তু অভাব যাহাদিগকে পীড়া দেয় তাহার কুকুর-বিড়ালেরও অধম । আমি বিবাহ করিবার লোভে অর্থ সঞ্চয় করিতেছিলাম। বহিঃপ্রকৃতির সহস্র বাধাও আমার সঙ্গিনীপিয়াসী মনকে দমাইতে পারে নাই । বিবাহ করিবার কি অদম্য স্পৃহা আমার ছিল বাবু তাহ আপনাকে বুঝাইতে পারিব না—নহিলে আমন দিনে মামুষে বাহির হয় না। আজ বিবাহ করিবার বিন্দুমাত্র প্রবৃত্তি আমার নাই ; প্রতি মুহূৰ্ত্তেই আমার শরীরের রক্ত জল হইয়া আসিতেছে ; আমি আর বেশীদিন বাচিলে পাগল হইয়া যাইব। শুধু ফুফুর মৃত্যুর প্রতীক্ষা করিতেছি ; সে আমার এই অবস্থার কথা জানিতে পারিলে কষ্ট পাইবে ।