পাতা:প্রবাসী (ষড়বিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৯৯৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

প্রবাল ৯২৭ ৬ষ্ঠ সংখ্যা ] ছাড়াছাড়ি । কাজ-কৰ্ম্মের ঝঞ্চাটে বিরহের তাগিদ এতদিন তার আর্জি পেশ করতে সময় পায়-নি। এখন অবকাশের দিনে সে জোর তাগিদ দিয়ে বসল। প্রবালের সমস্ত মন তখনই বন্ধু-মিলনে যাবার জন্যে উন্মুখ হ’য়ে উঠল। কিন্তু যশোদ রাজী হ’লেন না। চিরটা কাল গঙ্গাতীরে বাস করার পর শেষ বয়সে শোকাতাপা অবস্থায় অগঙ্গর দেশে যেতে তার মন চাইল না। তখন কেদারের মা বুঝিয়ে বললেন—“তবে দিদি, তুমি দিনকতকের জন্যে তীর্থ-ধৰ্ম্ম ক’রে এস ! এতে তোমারও মন স্বস্থ হবে, ছেলেটারও শরীর সেরে উঠবে।” যশোদা এঅবস্থায় সহজেই রাজী হ’লেন ; প্রবালও উদ্যোগ ক’রে মাকে নিয়ে তীর্থের পথে যাত্রা করলে। তার তরুণ মন তখন বন্দীত্বের অবসাদ হ’তে মুক্ত হ’য়ে নবীন আলোকের পুলকধারায় যেন মুক্তিস্নান ক’রে তাজ হ'য়ে উঠল । পড়াশুনা ও দেশ-বিদেশ সম্বন্ধে বিশেষ ক’রে অভিজ্ঞতালাভের আকাঙ্ক্ষা প্রবালের প্রাণে খুবই প্রবল ছিল। কিন্তু আর্থিক অসচ্ছলতার জন্যে সে তার এত বয়স পর্য্যন্ত দেশের বাইরে পা দিতে পারেনি। আজ দেশপ্রমণে তীর্থের পথে বার হয়ে তার ভারী আনন্দ বোধ হ’তে লাগল। প্রবাল নিজের মাকে চিরকালই খুব ভালোবাসত, প্রাণ ভরে শ্রদ্ধা করত ; আর সেই মা’রই আর-একটি রূপ যে জননী জন্মভূমি—তার প্রতিও তার কিছু কম অনুরাগ ছিল না। স্বদেশের প্রতি, স্বজাতির প্রতি তার একটি প্রগাঢ় মমতা ছিল । সমস্ত ভারতবর্ষকে সে নিজের চৰ্ম্ম-চক্ষে না দেখলেও অস্তরের চক্ষু দিয়ে সমগ্রের উপর দৃষ্টি বুলিয়ে নেবার ক্ষমতা যেন সহজ ভাবেই অর্জন ক’রেছিল। সেইজন্যে সে তার স্বভাবসুলভ ভালোবাসার জোরে সব দেশের লোককেই দেশভাই ব’লে মনে করতে পাবৃত। স্বদেশী আন্দোলন যখন সমস্ত দেশে হঠাৎ একট। দেশভক্তির প্লাবন এনে অনেককে হাবুডুবু পৰ্য্যন্ত খাইয়ে দিয়েছিল তখন প্রবাল তার মধ্যে ডুব দিতে না পারলেও 'ধ সে-আন্দোলনকে প্রাণমন দিয়ে অনুভব করতে পারেনি তা নয়। বরং সেইসময় দেশবাসীর ও রাজশক্তির মধ্যে প্রবল সংঘর্ষ যে একটা বিষম বিপ্লব স্থষ্টি করেছিল তাতে তার সমস্ত মন পীড়িত হ’য়ে উঠেছিল ; এবং গভীর ভাবেই সে নিজের মনে চিন্তা কর্ত—দেশের মুক্তি সত্যিই আজ কোন পথে ? তার চিন্তার মধ্যে গৰ্ব্বের লেশ ছিল না। সে প্রশ্নটাকেই ধরতে পেরেছিল— সমস্যার সমাধান করুবার মত চিন্তার নাগাল সে পায়-নি তখন | স্কুলের ছাত্রদের সে যে পড়াত তা ঠিক মাষ্টারীর বাধা ধরা নিয়ম মেনে নয় । ছেলে গুলিকে সে হাল্কা চোখে মোটেই দেখত না । তাদের মধ্যেই ভবিষ্যদেশবাসীর যে তরুণ মন গুলি মুকুলিত অবস্থায় রয়েছে সেগুলিকে সে ভারী শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখ ত ব’লে অত্যন্ত যত্বের সহিতই তাদের শিক্ষাদান করত। সহজেই স্বাভাবিক ভাবে যাতে তার নিজের দেশকে ভালোবাসতে পারে, দেশবাসীর ও স্বদেশের শিল্পের প্রতি অনুরাগশীল হয়, আত্মপ্রতিষ্ঠার ও আত্মকল্যাণলাভের জন্য সচেষ্ট হ’য়ে ওঠে এমনি ভাবে তাদের মনোবৃত্তি গুলিকে পরিপুষ্ট করবার চেষ্টা প্রবাল করত । এইসব কাজের জন্তে সে শুধু কতকগুলো মামুলী উপদেশ আউড়ে যেত না । ইতিহাস, ভূগোল, প্রভৃতি পড়বার সময় তার নিজের চোখ মুখ শিক্ষাদানের আনন্দে এমন উজ্জল হ’য়ে উঠত, কণ্ঠস্বর এমন মধুর ও গম্ভীর হয়ে কানে বাজত যে, ছেলেরা সহজেই এই মাষ্টারটির কাছে যে-পাঠ নিত সেটির মধ্যে তারা মুখস্থ করার বিভীষিকা দেখতে পেত না । জ্ঞানলাভের আনন্দে তারা মেতে উঠত। মা’কে নিয়ে প্রবাল প্রথমে শান্তিপুর, নবদ্বীপ হ’য়ে গয়া, বৈদ্যনাথ ধাম, কাশী, অযোধ্যা, জয়পুর, পুষ্কর, বৃন্দাবন, মথুরা প্রভৃতি তীর্থ পৰ্য্যটন ক’রে হরিদ্বার এসে. পৌছল। পথে সে তার দুই চক্ষুর পিপাসিত অনাবিল দৃষ্টি দিয়ে যা-কিছু দেখতে লাগল, তার মধ্য হ’তে অনেক অভিজ্ঞতা ও আনন্দ সঞ্চয় ক’রে নিলে । হরিদ্বারে গিয়ে সে এক পাণ্ডার অ প্রিয়ে উঠল। সেখানকার গম্ভীর দৃপ্ত তাকে এমন মুগ্ধ করলে যে, দিনকতকের জন্তে আর কোথাও তুরি নড়বার ইচ্ছা রইল না। দেবমন্দিরের সংলগ্ন বাজার ইত্যাদি গুলোর মধ্যে যদিও সেই কাশী,