পাতা:প্রবাসী (সপ্তত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/১৭৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

হুইটম্যান শ্ৰীবিজয়লাল চট্টোপাধ্যায় সাহিত্যের ইতিহাসে হুইটম্যানের আবির্ভাব একটি স্মরণীয় ঘটনা । কাব্যের জগতে এমন একটি স্বর তিনি বাজালেন যা সম্পূর্ণ নূতন। তার আবির্ভাবের পূৰ্ব্বে কাব্যস্থষ্টির উপাদান সংগৃহীত হ’ত রাজী-বাদশাহের অট্টালিকা থেকে ; সাহিত্য তৈরির জন্য যেতে হ’ত পৌরাণিক দেবদেবীদের কাছে। হুইটম্যান আবির্ভূত হলেন একটা অভিনব দৃষ্টি নিয়ে। তিনি দেখলেন, কবিতা লিখবার প্রচুর উপাদান রয়েছে নিতান্ত কাছেই—আমাদের প্রতিদিনের জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্যে। আমাদের চোখের সম্মুখেই মুহুর্তে মুহূৰ্ত্তে মানুষের জীবনের রঙ্গমঞ্চে এমন সব ঘটনার অভিনয় হয়ে যাচ্ছে যা নিয়ে অনবদ্য বহু কবিতা লেখা একেবারেই অসম্ভব নয়। হুইটম্যানের আবির্ভাবের পূৰ্ব্বে কবিতালক্ষ্মীর বিচরণের ক্ষেত্র ছিল সুসজ্জিত প্রমোদশালায় নৃপুরের নিক্কণ, পুপমালোর সৌরভ, প্রেমিক-প্রেমিকার অক্ষুট প্রণয়-গুপ্পন এবং বিলাসের বিচিত্র আয়োজনের মধ্যে। ওয়ার্ডসওয়ার্থ আর শেলীর কবিতায় গণতন্ত্রের স্বর অবশুই বেজে উঠেছে—কিন্তু মাটির খাটি সুর এবং মানুষের সহজ গরিমাকে প্রকাশ করবার জন্য প্রয়োজন ছিল হুইটম্যানের মত অসাধারণ কবির আবির্ভাবের । তিনি বললেন । কবি ইতে চাও? বেরিয়ে এস আকাশের তলায় মানুষের বিশাল হাটে। ভোর না হ’তেই কৃষক চলেছে ভূমি কর্ষণ করতে ; কচি ধানের সবুজ ক্ষেতে হাতে করে কাজ আর মুখে গায় গান। কবিতালক্ষ্মীর আনাগোনা ত ঐখানেই । ছোট শিশুটি নিদ্রা যায় দোলনায় ; হেমস্তের অপরাহ্লে ধানের গাড়ী নিয়ে চাষী ফিরে যায় প্রান্তর থেকে পল্লীর বুকে ; মুণ্ডাদের ছেলে আর মেয়েরা শুভ্ৰ জ্যোৎস্নায় সারারাত ধ’রে মাদল বাজায় আর নাচে ; ভরাগঙ্গার গৈরিক জলে জোয়ান জোয়ান ছেলের কাটে সাতার ; বিলের কালে জলে পানকৌড়ি দেয় নি:শব্দে ডুব ; মেঠো পথের ধারে পাতার আড়ালে ফুটে আছে বনমল্লিকা ; মশালের আলোয় রাজপথ আলোকিত ক'রে বর চলে বিবাহ করতে । রাজমিস্ত্রী বারে বারে হাক দেয় সুরকির জন্য ; খেয়াঘাটের মাঝি সারাদিন ধ'রে করে যাত্ৰী-পারাপার ; উকীলের চারি দিকে ভিড় ক'রে বসে আছে মক্কেলের দল ; ডাক্তার গম্ভীর মুখে নাড়ী দেখে আর ঘন ঘন ঘড়ির দিকে চায় ; নূতন বউ ঘোমটা টেনে ঘরের কোণে পান সাজে ; গৃহস্থের বধূ তুলসীমঞ্চে রাখে সন্ধ্যার প্রদীপ ; শয়নের আগে আয়নার সামনে দাড়িয়ে কুমারী করে কেশবিন্যাস ; শুভ্ৰবস্ত্রে মুতের দেহ ঢেকে দেয় আত্মীয়স্বজন আর তার উপরে রাখে রাশি রাশি পুষ্প ; সদ্যবিধবা সাশ্রণয়নে বহুকালের অলঙ্কার ফেলে খুলে আর সিছরের দাগ ফেলে মুছে ; পৌষের প্রভাতে গ্রামের ছেলেবুড়ে বন-ভোজনে যায় নদীর তীরে—যেখানে বটের তলায় সারা বেলা থাকে ছায়া ; বিরাট জন-সভায় বক্তার গুরুগম্ভীর কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে আসে অগ্নিগর্ত বাক্যের স্রোত আর শ্রোতাদের ধমনীতে ধমনীতে চঞ্চল হয়ে ছোটে রক্তধারা ; খেলোয়াড় উৰ্দ্ধশ্বাসে ছুটেছে ফুটবল নিয়ে আর অপরাত্যুের আকাশকে বারে বারে মুখরিত ক'রে উঠছে জনতার জয়ধ্বনি ; ছয় ঘোড়ার গাড়ীতে চড়ে জনাকীর্ণ রাজপথে পুষ্পবৃষ্টির মধ্যে আসে কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট ; গঙ্গার ঘাটে সদ্যহ্মাতা পুরনারী নতমস্তকে করে সূর্য্যপ্ৰণাম ; পবিত্র হোমাগ্নিকে ঘিরে নবীন পূজারীরা করে মম্বোচ্চারণ আর বীণাপাণির চরণে দেয় পলাশ ফুলের অগুলি ; চাপার কলির মত আঙলের ডগায় চন্দনের গেট নিয়ে বোন পরিয়ে দেয় ভায়ের কপালে ভাইক্টোটা। এমনি সহস্র সঙ্গস্ত্ৰ ঘটনা নিমেষে নিমেষে দিনরাত ঘটে যাচ্ছে আমাদের চক্ষুর সম্মুখে যা অনায়াসে কবিতার উপাদান হ'তে পারে । The marvellous envelops un and we breathe it like the atmosphere ; but we do not see it.